নুরুন্নাহার বানুর বিষয়ে একটা সত্য কথা হলো এই যে তিনি যখন ভেবেচিন্তে কিছু করেন, অবশ্যই ভুল করে বসেন। ঝোঁকের মাথায় যেসব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, পরে দেখা গেছে, সেগুলোতেই তার দূরদর্শিতা প্রমাণিত হয়েছে। রেবা তার ছেলে অম্ভ এবং বর ইকবালকে কিছুদিন বরিশাল থেকে এখানে আনিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে খুবই ভালো কাজ করেছেন। মেয়ে জামাই এবং নাতি আসাতে পরিবারের গুমোট হাওয়াটা অনেকখানিই কেটে গেছে। মেয়ে জামাই আসাতে খুবই ভালো হয়েছে, এ কথা আবু জুনায়েদও স্বীকার করেন। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলেননি। নুরুন্নাহার বানু আঁকড়ে ধরার মতো একটা অবলম্বন খুঁজে পেলেন। রেবা মেয়েটি ঠাণ্ডা স্বভাবের এবং অনেক বিচক্ষণ । রেবার যখন জন্ম, নুরুন্নাহার বানুর বয়স সবে মোল। আবু জুনায়েদ তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। পাস করার পরে জুনায়েদকে চাকরি পেতে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। রেবাকে মানুষ করতে গিয়ে অনেক ঝড় ঝাঁপটা মাথার উপর দিয়ে গেছে। আবু জুনায়েদের সঙ্গে এক রুমের একটি টিনের ঘরে নুরুন্নাহার দাম্পত্য জীবন শুরু করেছেন। তখন তাদের সংসারে প্রাচুর্য বলতে কিছুই ছিল না। দুধের পয়সার জন্য নুরুন্নাহার বানুকে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে তার আব্বার কাছে হাত পাততে হতো। দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মানুষ হয়েছে বলেই রেবার মধ্যে দয়ামায়ার ভাগটা খুব বেশি। দীলুর কথা স্বতন্ত্র। সে যখন জন্মেছে, নুরুন্নাহার বানুদের অবস্থা ফিরতে আরম্ভ করেছে। অধিকন্তু ঝুলি ঝাড়া সন্তান বলে দীলু সব সময় মা-বাবা দুজনেরই অবারিত স্নেহ লাভ করেছে। এখন নুরুন্নাহার বানুর আফসোস হয়, ছোটবেলা থেকে যদি মেয়েটাকে কড়া শাসনে রেখে মানুষ করতেন, আজকে তাকে এরকম একটা কুৎসিত অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো না।
দীলুর উপর তার কোনো নৈতিক অনুশাসন চলছে না। নুরুন্নাহার বানু খুব ভয়ে ভয়ে আছেন। যদি কোনো ফাঁকে দীলু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবেদ হোসেনের সঙ্গে কিছু একটা করে বসে, তখন নুরুন্নাহার বানু মানুষের সামনে মুখ দেখাবেন কেমন করে? এ ব্যপারটা নিয়ে আবু জুনায়েদের সঙ্গে আলোচনা করারও উপায় নেই। নুরুন্নাহার বানু গভীর বেদনার সঙ্গে অনুভব করছেন আবু জুনায়েদ তার দিক থেকে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। নুরুন্নাহার বানুর ভেতরটা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে। রেবা এসে পড়ায় তিনি একটি খুঁটি পেয়ে গেলেন। একদিন দরজা বন্ধ করে মা মেয়েতে দীলু এবং আবেদ হোসেনের ব্যাপারটা আলোচনা করলেন। রেবা সবকিছু শুনে শিউরে উঠল। সে নিজে থেকে এগিয়ে এসে আবু জুনায়েদকে সব কথা জানালো। সব কথা শুনে আবু জুনায়েদ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলেন। সহসা তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোল না। দীলু যে এরকম একটি কাজ করতে পারে আবু জুনায়েদ ভাবতেও পারেননি। মেয়েটি সবে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। আবু জুনায়েদের অবস্থা এমনিতে সবদিক দিয়ে টলোমলো হয়ে উঠেছে। এই ঘটনা যদি কোনো ফাঁক দিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ে একটা ভূমিকম্পের সৃষ্টি হবে। আবু জুনায়েদের অস্তিত্বটাই বরবাদ করে ফেলবে। বার হাত কাঁকুরের তের হাত বিচির মতো সমস্ত গোপন বিষয় মানুষের সামনে বেরিয়ে আসবে। সকলে জানবেন তিনি ঠিকাদার শেখ তবারক আলীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছেন। শেখ তবারক তার স্ত্রীকে জড়োয়া গয়নার সেট, কন্যাকে বেনারশি শাড়ি এবং সোনার ঘড়ি উপহার দিয়েছেন। তিনি নিজে থেকেই শেখ তবারককে একটা গাভী গরু কিনে দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। ঠিকাদার সাহেব তাকে মহামূল্যবান গরু এবং গোয়ালঘর দুই উপহারস্বরূপ করে দিয়েছেন। এসবের সঙ্গে দীলুর কথাটা যখন যোগ হবে, মানুষ আপনা থেকেই বলবে, আবু জুনায়েদ এত লোভী এবং চামার যে তিনি আপন মেয়েটিকেও তবারক আলীর জামাতার হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠিত হননি। আবু জুনায়েদ আর অধিক কিছু চিন্তা করতে পারলেন না। তার কপালের বাম পাশটা প্রচণ্ডভাবে ব্যথা করছিল। প্রেসার চড়ে যাচ্ছিল। কোনো রকমে কপাল চেপে ধরে খাটে শুয়ে পড়তে পড়তে বললেন।
-যা হয় কিছু একটা করো। আমি তো চোখে পথ দেখছিনে।
রেবা একাই সমস্ত পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল। মা-বাবার মধ্যে একটা কাজ চলা গোছের সম্পর্কও তৈরি করে ফেলল । কিন্তু সেটাকে স্বাভাবিক সম্পর্ক বলা চলে না। একেবারে নিসম্পর্কিতভাবে মানুষের এক সঙ্গে থাকা চলে না। রেবা ভীষণ বুদ্ধিমতি মেয়ে। দীলুকে সব সময় চোখে চোখে রাখে। কোনোক্রমেই বাড়ি থেকে একা বেরোতে দেয় না। কলেজে যাবার সময় রেবা কিংবা তার স্বামী দীলুর সঙ্গে কলেজের গেট অবধি যায়। আবার ছুটি হওয়ার পরে কলেজ গেট থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। কলেজের প্রিন্সিপাল ভদ্রমহিলার সঙ্গে আবু জুনায়েদের পরিচয় আছে। তিনি তাকে টেলিফোন করে বলেছেন, তার এই মেয়েটি বড় আদুরে এবং খেয়ালি। কখন কী করে বসে কোনো ঠিক নেই। সুতরাং বেগম হাসনা বানু যদি অনুগ্রহ করে মেয়েটির প্রতি কড়া নজর রাখেন তবে আবু জুনায়েদ খুবই উপকৃত বোধ করবেন। কলেজ সম্পর্কিত অনেক কাজে উপাচার্যের কাছে হাসনা বেগমের ঠেকা আছে। তাই বেগম হাসনা বানু কথা দিয়েছেন, হাঁ মেয়েটির প্রতি তিনি প্রখর দৃষ্টি রাখবেন। তবে এও বলেছেন, এসব টিন এজারদের কন্ট্রোল করা খুবই মুশকিলের ব্যাপার।