লোকজন যখন থাকে না, লুকিয়েচুরিয়ে গরুটাকে দেখে আসেন। গরুটাকে অনেকটা সতীনের মতো ধরে নিয়ে গোয়াল ঘর থেকে ঝাড় কুড়িয়ে নিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দেন।
একদিন তিনি গোয়াল ঘরের কাছে গিয়ে খিলখিল হাসির শব্দ পেলেন। তার ভেতরের সংস্কারটি চাড়া দিয়ে উঠল । কে জানে কোনো জিন পরি আবার গাভীর আকার ধরে তার স্বামীর উপর ভাগ বসাতে এসেছে কি না। তিনি আরো একটু এগিয়ে গেলেন। দরজার ফাঁক দিয়ে যা দেখলেন, তার সেই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে হলো। কী করবেন ভেবে পেলেন না। মিনিটখানেক স্তব্ধ হয়ে রইলেন। আবেদ হোসেন দীলুর স্তন টিপে টিপে আদর করছেন। আর দীলু তার গলা জড়িয়ে ধরে খিল খিল করে হাসছে। নুরুন্নাহার বানুর মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে গেল,
–হারামজাদি আজ তোর একদিন, আমার একদিন।
আবেদ হোসেন গলার আওয়াজ শুনে তড়িতাহতের মতো উঠে দাঁড়ালেন,
–আপা আপনি!
–বেরো কুত্তার বাচ্চা, বেরো!
আবেদ হোসেন মুখটা নিচু করে নুরুন্নাহার বানুর সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এবার নুরুন্নাহার বানু প্রচণ্ড রোষে তার মেয়ের চুলের মুঠি ধরতে ছুটে গেলেন। মুখ দিয়ে গালাগালির খই ফুটতে থাকল। তার ওই মূর্তি দেখে মেয়েটি কিন্তু একটুও ভয় পেল না।
–তুমি এরকম চেঁচামেচি করছ কেন? কী হয়েছে?
–কী হয়েছে হারামজাদি তোমাকে দেখাব?
তিনি চুলের মুঠিতে হাত দিতে যাচ্ছিলেন। দীলু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
–আম্মা বলে দিচ্ছি গায়ে হাত দিয়ো না। ভালো হবে না কিন্তু।
–হারামজাদি আজ তোর গোর দিয়ে ছাড়ব।
–গোর দেয়া অত সহজ কাজ নয়। যা বলার বলো, গায়ে হাত দিতে চেষ্টা করো না। গায়ের জোরে আমার সঙ্গে তুমি পারবে না।
–হারামজাদি এই কুত্তার সঙ্গে করছিলি কী?
–যা ইচ্ছে করছিলাম, তোমার কী? আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে মজা করছিলাম।
–মজা করছিলি হারামজাদি, তোর কোন মায়ের পেটের ভাই, একটা আলগা বেটাকে তুই বুনি টিপতে দিলি?
–সো হোয়াট, আমি আবেদ ভাইকে বিয়ে করব।
মেয়ের দুঃসাহস, নির্লজ্জতা এবং স্পর্ধা দেখে নুরুন্নাহার বানুর মুখ দিয়ে সহসা কথা বেরুল না।
–বিয়ে করবি, জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
–কেন নয়, আবেদ ভাইকে আমার দারুণ ভালো লাগে ।
–বিয়ে করবি হারামজাদি, তার বউ আছে, বাচ্চা আছে।
–থাকুক না কেন, আবেদ ভাই এই বউকে নিয়ে সুখী নয় ।
–তুই হারামজাদি সুখী হবি?
–অনেক গালাগালি করেছ। আর চিৎকার করলে আমি এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব। সুখী হব না হব আমার ব্যাপার। তোমার তাতে কী?
নিজের মেয়ের সঙ্গে নোংরা বচসার পর হঠাৎ করে নুরুন্নাহার বানু অনুভব করলেন, তার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তার তলার সবটুকু মাটি সরে গেছে। স্বামী তার অনুগত নয়। তাকে বিছানায় একা ফেলে একটা গরুর সঙ্গে রাতে এসে কী সব করে। আর নিজের মেয়েটির বাজারের খানকি হতে আর বাকি কই। তবারক আলীর জড়োয়া গয়না, বেনারশি শাড়ি, সুন্দর করে বানানো গোয়াল ঘর, লক্ষ টাকা মূল্যের গাভীন গরু তাকে একদিক দিয়ে সর্বস্বান্ত করে ফেলেছে। তিনি মনে মনে অনুভব করলেন তবারক আলী একজন শয়তান। তিনি যা কিছু স্পর্শ করবেন সেখানে পাপ ছাড়া আর কিছুই জন্মাতে পারে না। তার সারা গা জ্বালা করতে লাগল। এই অবস্থায় শোয়ার ঘরে ঢুকে আধাদিন ফুলে ফুলে কাঁদলেন। তারপর এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। বিকেল চারটের দিকে ঘুম ভেঙেছিল। সারা শরীরে অসম্ভব ক্লান্তি । নুরুন্নাহার বানুর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। নুরুন্নাহার বানুর ইচ্ছে হলো এক্ষুনি যদি তিনি তবারক আলীর দেয়া সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন, তাহলে বাঁচার একটা উপায় হয়তো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু শাড়ি গয়না ওসব তিনি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন কোথায়? কাজের লোকজনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারেন। কাজের বেটির গায়ে জড়োয়া গয়না কী মানায়! তার চেয়ে নুরুন্নাহার বানুর কাছেই থাকুক। নারী হৃদয় বড় বেশি সোনার বশীভূত।
আবু জুনায়েদ অফিস থেকে এসে নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। নুরুন্নাহার বানুও কোনো কথা বলতে চেষ্টা করলেন না। এই একদিন একরাতের মধ্যে তাদের মধ্যে একটা দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে গেছে। হাজার চেষ্টা করেও কেউ কারো কাছে আসার উপায় পাচ্ছে না। নুরুন্নাহার বানুর মন থেকে ক্রমাগত ধিক্কার ধ্বনি উঠছিল। সমস্ত পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা আছে যেখানে তার এই মস্ত ক্ষতির কথা প্রকাশ করতে পারবেন। তিনি কোথায় যাবেন? তার মুখ দিয়ে তেতো ঢেকুর উঠছিল। এই বাড়িতে তিনি কীভাবে বাস করবেন। অনেক ভেবে, অনেক চিন্তা করে স্থির করলেন, রেবা, তার ছেলে এবং বরকে আনিয়ে নেবেন।
.
১১.
হাত পায়ের একটা হাড় ভেতর থেকে ভেঙে গেলে যে রকম হয়, বাইরে কোনো রক্তপাত ঘটে না অথচ টনটনে ব্যথাটা ঠিকই থাকে; আবু জুনায়েদের সংসারেরও সে অবস্থা। নুরুন্নাহার বানু এবং আবু জুনায়েদের মধ্যে কথা বলাবলি বন্ধ। বিয়ের পর এরকম অবস্থা আগে কোনোদিন হয়নি। নুরুন্নাহার বানু এখন বড় হওয়ার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। দীলু আপন ইচ্ছেমতো সবকিছু করছে। যখন তখন বাইরে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এসকল কথা জিজ্ঞেস করে দেখার কোনো প্রয়োজন নুরুন্নাহার বানু অনুভব করেননি। তিনি মনে করছেন তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। শেখ তবারক আলী তাদের গোটা পরিবারটাকে সর্বনাশ করে ফেলেছেন। এই সংসারের প্রতি কোনো কর্তব্য, কোনো টান তিনি বোধ করেন না। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলেই তিনি এই বাড়িতে পাপী মানুষজনের সঙ্গে দিন-রজনী যাপন করছেন।