সে রাতে আবু জুনায়েদ খাবার স্পর্শ করলেন না। কারো সঙ্গে কথা বললেন না। তিনি দোতলার বারান্দায় পায়চারী করতে থাকলেন। দুবার ফোন এসেছিল, বলে পাঠিয়েছেন কথা বলতে পারবেন না। রাত যখন এগারটার মতো বাজে আবু জুনায়েদ উপাচার্য ভবনের বাইরে এসে বাগানে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। তার ঘরে প্রবেশ করতে ইচ্ছে হলো না। পায়ে পায়ে তিনি তরণী নিবাসে চলে এলেন। দেখাশোনা করার লোকটি রাতের বেলা থাকে না। আটটা বাজলেই চলে যায়। তিনি গোয়াল ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দেখেন তরণী লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। আবু জুনায়েদ মশারির দড়ি খুলে দিয়ে গরুটার শরীর স্পর্শ করলেন। আবু জুনায়েদের ছোঁয়া লাগামাত্রই গরুটা একলাফে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। তরণীর চোখে আবু জুনায়েদের চোখ পড়ে গেল। তার মনে হলো গরুটি ছলোছলো দৃষ্টিতে তার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছে। আবু জুনায়েদ সবকিছু ভুলে গিয়ে গরুটাকে আদর করতে থাকলেন। তরণী একটু পেছনে হটে গিয়ে আবু জুনায়েদের হাত পা গাল চাটতে লাগল। আবু জুনায়েদের মনে হলো এই বোবা প্রাণীটি ছাড়া তার বেদনা অনুভব করার কেউ এই বিশ্বসংসারে নেই। গরুটা নির্বাক নয়নে আবু জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আবু জুনায়েদের ওলানের দিকে চোখ গেল। বাচ্চা হবে, বাঁটগুলো আস্তে আস্তে পুষ্ট হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। হঠাৎ করে ওলানটা ধরে দেখবার ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসল। প্রথম গরুটা দেখার সময়ও এরকম একটা ইচ্ছে তার মনে জেগেছিল। কিন্তু তিনি সংকোচবশত ওলানের তলায় হাত দিতে পারেননি। কোনো মানুষের সামনে এটা করা কোনোদিনই সম্ভব হতো না। গভীর রাতে সবকিছু বাঁধন আলগা হয়ে পড়ে, এমনকি চেতনার শাসন অস্বীকার করে স্বপ্নেরা ভিড় করে বাইরে আসার অবকাশ পায়। সুতরাং, আবু জুনায়েদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেটা পূরণ করতে বাধা কোথায়। তিনি ওলানের তলায় হাত দিয়ে বাঁটগুলো টিপে টিপে দেখছিলেন। তরণীর বোধহয় এই স্পর্শসুখ ভালো লাগছিল। গরুটি পেছনের পা-দুটি ফাঁক করে আবু জুনায়েদকে অধিকতর অবকাশ করে দিল। ওলানটা রক্তিম বর্ণের। এই তুলতুলে মাংসপিণ্ড স্পর্শ করামাত্রই তার স্মৃতিতে ভেসে উঠল, আজ থেকে অনেকদিন আগে, যখন তার সবে গোঁফ গজিয়েছে, শিশ্নের মধ্যে বীর্যসঞ্চার হয়েছে, এক দূর সম্পর্কীয়া মামী আবু জুনায়েদকে দিয়ে তার বিশাল বিশাল স্তন মর্দন করিয়েছিলেন। আবু জুনায়েদের মনে সেই পুলক, সেই অনুভূতি জেগে উঠল। আবু জুনায়েদের মনে হলো তরণীর এই রক্তিম ওলান, এই স্ফীত বাটগুলোর মধ্য দিয়ে চরাচরের নারীসত্তা প্রাণ পেয়ে উঠেছে।
আবু জুনায়েদের হাতে ঘড়ি ছিল না। রাত কত হয়েছে ধারণা নেই। একসময় দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আবু জুনায়েদ উঠে দাঁড়ালেন। মশারিটা ফের খাঁটিয়ে দিতে গিয়ে দেখতে পেলেন জানালার পাশে মনুষ্যছায়া বাঁকা হয়ে পড়েছে। আবু জুনায়েদ একটু শিহরিত হলেন। এতরাতে এই গোয়াল ঘরে তার খোঁজ করতে কে আসতে পারে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে?
আমি, নুরুন্নাহার বানুর কণ্ঠস্বর।
–তুমি এখানে কেন এসেছ, আবু জুনায়েদ জানতে চাইলেন।
আবিয়ানো গাইয়ের ওলানে কী খোঁজ করছ একটু দেখে জীবন সার্থক করতে এলাম।
আবু জুনায়েদ আশা করেন নি নুরুন্নাহার বানু এভাবে তার উপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারেন। প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। সেটা সামলে উঠলেন। চরম বিতৃষ্ণায় তিনি চিন্তা করলেন, এই মেয়ে মানুষটির হাত থেকে এ জীবনে তিনি নিষ্কৃতি পাবেন না । নুরুন্নাহার বানুর কথার জবাব দিতে গিয়ে সমান রূঢ়তাসহকারে বলে বসলেন।
–সেটা জেনে তোমার লাভ কী? তোমার কী আছে? তুমি ওলানের মধ্যে কী খোঁজ করছি এটা জানতে এখানে গুপ্তচরগিরি করতে এসেছ? তুমি ঝগড়া-ঝাটির একটা বাক্স ছাড়া আর কি?
–এ কথা তো তুমি বলবে। তোমার বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্টি সকলে গরুর সঙ্গে কুকর্ম করেছে, তুমি সেই বংশের ছাওয়াল একই কাজ তোমাকে করতে হবে । নুরুন্নাহার বানুর চোখ দুটো থেকে ঠিকরে আগুন বেরিয়ে এল। আবু জুনায়েদ আবছা অন্ধকারে লাল চোখ দেখতে পেলেন।
সেই কুৎসিত বাদ-প্রতিবাদের রাত নুরুন্নাহার বানু এবং আবু জুনায়েদ কীভাবে কাটিয়েছেন, এ নিয়ে চাকর-বাকরেরা একেকজন একেক রকম কথা বলে থাকে। তার পরে আরো কিছু ঘটনা ঘটে গেল । সেগুলো সবিস্তারে না তোক সংক্ষেপে বলা প্রয়োজন। উপাচার্য ভবনে আবেদ হোসেনের অবারিত গতায়ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন কাজ তদারক করতে এলে নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যান। নুরুন্নাহার বানু তবারক চাচার এই সুদর্শন জামাইটিকে পছন্দ করেন। কারণ শুধু তার চেহারা নয়, স্বভাব চরিত্র কথাবার্তা সব সুন্দর। মাঝে-মাঝে আবেদকে নুরুন্নাহার বানুর ছোট ভাইটির মতো আদর করতে ইচ্ছে হয়। সব দিন নুরুন্নাহারের সঙ্গে আবেদের সাক্ষাৎ হয় না। এদিকে নুরুন্নাহার বানুর মনে অন্য রকম একটা ভাবনা কাজ করছিল। সেই রাতেই তিনি ঠিক করে ফেলেছেন আবু জুনায়েদের শখের গরুটাকে সময় এবং সুযোগ এলে তিনি বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবেন। সিদ্ধান্তটা কীভাবে কার্যকর করা যায় এ নিয়ে কল্পনা-জল্পনা করছেন। গরুটা মারা গেলে আবু জুনায়েদ কী রকম কষ্ট পাবেন, সে কথা চিন্তা করে একধরনের বিকৃত সুখ পেয়ে থাকেন। আবু জুনায়েদের এই শখের গরু যখন অক্কা পাবে, যখন নড়বে না, চড়বে না, নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকবে, তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বলবেন তোমার আদরের গাভী প্রেমিকার কবরের উপর একটা তাজমহল বানিয়ে দাও। যুগ যুগ তোমার নাম থাকবে।