একদিন বিকেলবেলা ফিন্যান্স কমিটির মিটিং ছিল। বরাবরের মতো আবু জুনায়েদ প্রিসাইড করছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন্ খাতে কত টাকা বরাদ্দ করা হবে, বাজেট তৈরির বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এই মিটিংয়ে কোষাধ্যক্ষ সাহেবও ছিলেন। নিরপেক্ষ এবং ন্যায়বান শিক্ষক হিসেবে ড. আকরাম সকলের শ্রদ্ধার পাত্র । আলোচনার এক পর্যায়ে ইতিহাস বিভাগের এক ফাজিল ছোকরা সরাসরি আবু জুনায়েদের চোখে চোখ রেখেই বলে বসলেন, আবু জুনায়েদের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচুর অর্থের অপচয় হয়েছে। তিনি তার দলভুক্ত কতিপয় অযোগ্য ব্যক্তিকে নানা প্রকল্পের পরিচালক করে দিয়েছিলেন। বাজেটের টাকা শেষ হয়ে গেছে, অথচ কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। ফসিউদ্দিনের কাছ থেকে আবু জুনায়েদ ওরকম ব্যবহারই আশা করেছিলেন। ফসিউদ্দিনের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছিল না। একটা থার্ডক্লাস এবং ব্রেক অব স্টাডি ছিল। একজন ছাত্রীর অভিভাবকও শিক্ষক সমিতির কাছে সরাসরি লিখিত অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি তার কন্যাকে উত্যক্ত করেছেন। এত সব সত্ত্বেও আবু জুনায়েদ একা এককাট্টা হয়ে তাকে প্রফেসর বানিয়েছেন। অনেক প্রবীণ ব্যক্তিদের পাশ কাটিয়ে তাকে ফিন্যান্স কমিটিতে নিয়ে এসেছেন। সেই লোকটি আজ মিটিংয়ে তাকে তুলোধুনো করে ছাড়লেন। সবচাইতে দুঃখের কথা হলো, আকরাম সাহেব ফসিউদ্দিনের পক্ষেই কথা বলেছেন। কমিটির কেউ তাকে সমর্থন করতে এগিয়ে এলেন না।
আবু জুনায়েদ ঠাণ্ডা স্বভাবের মানুষ। মুখের উপর গালমন্দ করলেও চটার স্বভাব তার নয়। মেজাজের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য দিলরুবা খানম বলে থাকেন আবু জুনায়েদের শরীরে মাছের রক্ত। তার মাথাটা অপেক্ষাকৃত ছোট বলেই দিলরুবা খানম ইদানীং বলতে আরম্ভ করেছেন, মানুষের শরীরে বোয়াল মাছের মাথা জুড়ে দিলে যেমন লাগে আবু জুনায়েদকে অবিকল সে রকম দেখায়। রসিকতাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে গেছে। আবু জুনায়েদের কানেও এসেছে। বোবা প্রাণীর মতো সহ্য করা ছাড়া আবু জুনায়েদের করবারই বা কী আছে! কিন্তু আজকে ফিন্যান্স কমিটির মিটিংয়ে নাজেহাল হওয়ার ব্যাপারটি তাকে প্রচণ্ড রকম জখম করে ফেলল। তার মনে হতে লাগল তিনি কতগুলো হিংস্র প্রাণীর সমাজে বাস করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালুমনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভায় বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল। তার মনটা এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে ঠিক করলেন যাবেন না। ব্যক্তিগত সহকারীকে বলে দিলেন, যেন জানিয়ে দেয়া হয়, তিনি সুস্থ বোধ করছেন না, সুতরাং অ্যালুমনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভায় যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। আবু জুনায়েদ সরাসরি বাড়িতে চলে এলেন।
বাড়িতে এসে দেখেন নুরুন্নাহার বানু রেগে আগুন হয়ে আছেন। আজ তার বড় বোনের ছোট মেয়ের গায়ে হলুদের দিন। নুরুন্নাহার বানু গাড়িতে করে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তিনি বলে দিয়েছিলেন, ড্রাইভার যেন বেলা চারটার দিকে এসে নিয়ে যায়। ড্রাইভার তাকে আনতে যায়নি। এসে যখন কারণ জানতে চাইলেন ড্রাইভার একগাল হেসে জানালো সাহেব তাকে না করেছে। আসলে তিনি এরকম কিছু বলেননি। তিনি বলেছিলেন ফিন্যান্স কমিটির মিটিংয়ের শেষে তিনি অ্যালুমনাই। অ্যাসোসিয়েশনের সভায় যাবেন। ড্রাইভারকে সেখানে তাকে নিয়ে যেতে হবে । মিটিং শেষ করে আবু জুনায়েদ ফিরে আসবেন, তারপর ড্রাইভারের ছুটি।
আবু জুনায়েদ বাড়িতে এসে দেখলেন, এই ভর সন্ধ্যেবেলা নুরুন্নাহার বানু খাটের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছেন। তিনি প্রমাদ গুনলেন। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। ফাটাফাটি না বাঁধিয়ে নুরুন্নাহার বানু ছাড়বেন না । আবু জুনায়েদ ভীষণ শঙ্কিত হলেন। তিনি কপালে হাত রাখলেন। শরীর ঠাণ্ডা। আস্তে আস্তে গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলেন, এই ওঠো, এই সন্ধ্যাবেলায় শুয়ে থাকলে শরীর খারাপ করে। নুরুন্নাহার বানু ওইটুকুর অপেক্ষা করছিলেন। চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
-আমার শরীর খারাপে তোমার কী আসে যায়। প্রতিদিন নিজে অপমান করো, আজ ড্রাইভার দিয়ে এই এতগুলো মানুষের সামনে অপমান করালে। তোমাকে ছোটলোকের বাচ্চা না বলে বলব কী? ছোটলোকের বাচ্চা নুরুন্নাহার বানু তাকে এই প্রথম বলছেন না, বিয়ের পর থেকেই এই ডাক শুনে আসছেন এবং শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না ড্রাইভার কীভাবে অপমান করতে পারে। তিনি ড্রাইভারের সন্ধানে গেলেন। দারোয়ান জানালো, ড্রাইভার গ্যারেজে গাড়ি রেখে চলে গেছে। আবু জুনায়েদকে ঘটনাটি মেয়ে দীলুর কাছ থেকে শুনতে হলো। দীলু জানালো, কথামতো না যাওয়ায় তাকে এবং তার আম্মাকে বেবিট্যাক্সি করে মীর হাজিরবাগ থেকে আসতে হয়েছে। আবু জুনায়েদ ভেবে দেখলেন, ড্রাইভার বেচারির কোনো দোষ নেই। আবু জুনায়েদের নিজের ভুলের জন্য এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি মনে করলেন, এই কথাটা নুরুন্নাহার বানুকে বুঝিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করবেন। তিনি যখন ব্যাখ্যা করার জন্য ঘরে ঢুকলেন, দেখেন নুরুন্নাহার হাপুস-হুপুস শব্দ করে কাঁদছেন। আবু জুনায়েদকে দেখামাত্র তার মুখ ছুটে গেল। শ্রীমুখ থেকে নানা রকমের গালাগাল নির্গত হতে লাগল। নুরুন্নাহার বানুর সম্পর্কে একটা মজার ব্যাপার হলো এই যে, কাপড়চোপড়ে কেশবিন্যাসের দিক দিয়ে তিনি শহরের অভিজাত মহিলাদের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার কথা চিন্তা করলেও যখন প্রয়োজন হয়, সুপ্ত উৎস থেকে গ্রাম্য গালাগালগুলো তার বাকযন্ত্র দিয়ে কই মাছের মতো উজিয়ে আসতে থাকে। মুখের সুখ মিটিয়ে শান্ত হলেন না। তারপর দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলেন। অত যত্নে বিউটি পারলারে গিয়ে বাঁধানো খোঁপা খুলে যাওয়ার ভয়ে অধিক ঢুসাটুসি করলেন না। রাগ প্রকাশের অধিক একটি কার্যকরী পন্থা বেছে নিলেন। পানির জগ, চায়ের পেয়ালা, পিরিচ, ফুলদানি যা হাতের কাছে পেলেন আছড়ে আছড়ে ভাঙতে থাকলেন। আবু জুনায়েদ টু শব্দটি করলেন না। চাকরবাকরেরা শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে এই প্রলয় কাণ্ড দেখল। আবু জুনায়েদ সকলের সামনে দিয়ে দাগী আসামীর মতো মুখ করে শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাকে কারো কিছু বলার সাহস হলো না।