আবু জুনায়েদের মন মেজাজ ইদানীং খুব খিচরে থাকে। মন খুলে কথা বলার মতো কোনো বন্ধু তার নেই। নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে তার কোনোরকম ভাব বিনিময় সম্ভব নয়। এখন নুরুন্নাহার বানুর অধীনে অনেক চাকর বাকর। নিজের হাতে কুটোটি ছিঁড়তে হয় না। এই বাড়তি সময় তিনি রূপচর্চার কাজে ব্যয় করেন। মেয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখে কাঁচা হলুদ, মশুর ডাল বাটা এসব মাখেন। শ্যাম্পু দিয়ে মাথার হাল্কা হয়ে আসা চুলগুলো ফুঁপিয়ে ফুলিয়ে তোলেন। জুতোর হিলের উচ্চতা বৃদ্ধি করেই যাচ্ছেন। যখন তখন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান, আবু জুনায়েদ প্রয়োজনের সময়ও গাড়ি পান না।
ভেতর বাইরে দুদিকের চাপ যখন প্রবল হয়ে ওঠে, আবু জুনায়েদ তরণী নিবাসে গরুটির কাছে ছুটে যান। ক্রমাগত যাওয়া-আসার ফলে গরুটি তাকে চিনে ফেলেছে। তিনি যখন সামনে গিয়ে দাঁড়ান, গরুটি তার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তিনি যে খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছেন, গরুটি বুঝতে পারে। আবু জুনায়েদ তরণীর মসৃণ পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। কুচিকুচি করে কাটা ঘাসের চুপড়িটা সামনে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। তরণী ধীরে-সুস্থে মন্থরভাবে অল্প-অল্প ঘাস গলায় চালান করতে থাকে। তরণীর কাছে যতক্ষণ থাকেন তিনি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে যান। তার মনে কোনো সন্তাপ, কোনো দুশ্চিন্তা থাকে । তিনি নিজের কাছে অনেক পরিমাণে লঘু হয়ে উঠতে পারেন। শেখ তবারক আলী যে লোকটিকে নিয়োগ করেছেন, তার কাছ থেকে তরণী সংক্রান্ত নানা সংবাদ খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চেষ্টা করেন। তিনি জেনেছেন তরণী এখন তিনমাসের গাভীন। ছয় মাসের মধ্যে তার বাচ্চা হবে। তখন তরণী মাসে আধমন করে দুধ দেবে। কিন্তু গাভীন অবস্থায় এ ধরনের গরুকে খুব সাবধানে রাখতে হয়। গরুকে নিয়মিত হাঁটা চলা করানো প্রয়োজন, যাতে করে তার শরীরের সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল থাকে। প্রসব করার সময় যে কঠিন শ্রম করতে হবে, তার জন্য নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করে আসন্ন গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে তরণীকে প্রস্তুত করতে হবে। কী কী করতে হবে, তার সবটা লোকটিরও জানা নেই। যখন সময় ঘনিয়ে আসবে তবারক সাহেব বলেছেন, নিয়মিত ডেয়ারি ফার্ম থেকে পশু ডাক্তার এসে দেখে যাবেন। তরণীর পেটের বাচ্চাটির সম্বন্ধেও আবু জুনায়েদ কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। স্থির করলেন কীভাবে নিরাপদ প্রসব করানো যায়, সে বিষয়ে তিনি খবরাখবর নেবেন।
এই চতুষ্পদ দুহিতার কাছে আসা-যাওয়া করতে গিয়ে আবু জুনায়েদের সামনে শব্দ এবং রূপের একটা নতুন জগৎ উন্মোচিত হলো। আবু জুনায়েদ গ্রামের ছেলে। গ্রামে থাকতে তিনি কখনো পাখির ডাক শুনেছেন মনে পড়ে না। গাছে পাতা হয়, এ তথ্য তার অজানা ছিল না। কিন্তু মাঘ মাসে শীর্ণ গাছের শরীর থেকে কী করে পত্রাঙ্কুর বিকশিত হয়, তিনি দেখেননি। পড়ন্ত বিকেলে নিরিবিলি গরুটিকে সঙ্গ দান করতে গিয়ে গাছের ডালে ডালে পাখিদের ওড়াউড়ি প্রত্যক্ষ করেন। তিনি ঘুঘুদের গলা ফুলিয়ে ডাকতে শোনেন। বুলবুলির টুকরো টুকরো মিষ্টি আওয়াজ, শালিকের কিচিরমিচির ডাক, দোয়েলের একটানা শিস শুনতে শুনতে আবু জুনায়েদ ভিন্ন জগতের মানুষ হয়ে যেতেন। তিনি ভাবতে থাকেন, মানুষের ভেতর এত প্রতিহিংসা, এত রেষারেষি, এত উঁদুর দৌড় কেন? মানুষের জীবন কত সংক্ষিপ্ত । পাখিদের ডাক শুনেই তো একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব। তরণী নিবাসের পাশের জারুল গাছটির ডালে পাতা গজাতে আরম্ভ করেছে। পয়লা রঙ ছিল বেগুনি, এখন সবুজ হয়ে উঠেছে। জন্মানো থেকে ঝরে পড়া পর্যন্ত গাছের পাতারও একটি নিজস্ব জীবন আছে। এ রকম সময়ে আবু জুনায়েদকে এক ধরনের দার্শনিকতায় পেয়ে বসে। ইতিপূর্বে যে কথা তার মনে আসেনি, সেসব বিষয় আস্তে আস্তে চিন্তার ভেতর ঘাই মারতে থাকে। মানুষের পরমায়ু কত সংক্ষিপ্ত। এই যে মানব জীবন, তা কি একেবারে অর্থহীন? নাকি মানব জীবনের একটা লক্ষ্য আছে।
আবু জুনায়েদের জীবন নিজের অজান্তেই তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নিয়মিত অফিসে যান, আসেন। নিজের দলের লোক তাকে অপদার্থ বলে সমালোচনা করেন। বিরুদ্ধপক্ষের লোক তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ এনে জনমত তৈরি করছেন। সরকার ধাতানি দেন, বিরোধী দল হুমকি দেন। ছাত্রেরা প্রতিদিন চেপে ধরে স্পঞ্জের মতো রস বের করে ছাড়ছে। পাশাপাশি রয়েছে তার পারিবারিক জীবন। আবু জুনায়েদেরা তিনটি প্রাণী মাত্র। স্ত্রী নুরুন্নাহার বানু, মেয়ে দীলু এবং স্বয়ং তিনি। পারিবারিক জীবনেও আবু জুনায়েদ সুখী নন। নুরুন্নাহার বানুর চাহিদা উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। তার দুর্মূল্য জড়োয়া গয়না হয়েছে। হুকুম তামিল করার চাকর-বাকর হয়েছে, এমনকি লাবণ্যও অনেকদূর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিধি অনেকদূর বিস্তৃত। বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ার শিক্ষক গিন্নি যারা অতীতে নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি, দেখিয়ে দিতে চান, ফারাকটা কতদূর। নুরুন্নাহার বানু কোথায়, আর তারা কোথায়? তার ভাইরা যে সমস্ত ছোট লোকদের মেয়েদের বউ করে এনেছেন, তাদের সঙ্গেও একটা ফয়সালা করতে হবে বৈকি। সারা জীবন ভায়ের বউরা তাকে অবজ্ঞা করে এসেছে, এবার নুরুন্নাহার বানুর জবাব দেবার পালা। শেখ তবারক আলীর বাড়িতে যে অত্যাধুনিক বহুমূল্য গৃহ সরঞ্জাম দেখে এসেছেন, সে রকম সাজসরঞ্জাম তারও চাই । নুরুন্নাহার বানু মুখে না বললেও স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার এই সমস্ত দাবি আবু জুনায়েদকেই পূরণ করতে হবে। তিনি তার সমস্ত সাধ আহ্লাদ পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকজনের সামনে কলেমা পড়ে বিয়ে করেছেন। আবু জুনায়েদ কোন মুখে কোন সাহসে এখন না করবেন। নুরুন্নাহার বানু কি যেমন তেমন বাপের বেটি। তার আব্বা কি আবু জুনায়েদের লেখাপড়ার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেনি? দিনে দিনে আবু জুনায়েদের পারিবারিক জীবনটা একটা নরককুণ্ড হয়ে উঠল। অফিস এবং পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি হালফিল আবু জুনায়েদ আরেকটা গোপন জীবনের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। আবু জুনায়েদ মনে করেন, এই দিকটি যদি তার সামনে প্রকটিত না হতো, তার জীবন আরো অনেক বেশি ব্যথা-দীর্ণ হয়ে উঠত। মনে মনে আবু জুনায়েদ গরুটার কাজে ঋণী অনুভব করেন। গরুটা সময়মতো তার গোয়ালে এসেছিল বলেই আবু জুনায়দের কাছে জীবন অনেকখানি সহনীয় হয়ে উঠেছে। তিনি রাতের বেলা ঘুমোতে যাবার আগে চিন্তা করেন সকালে ঘুম থেকে উঠে গরুটার মুখ দেখবেন। অফিসে যাওয়ার সময় ভাবেন, ফিরে এসে গরুটাকে দেখতে পাবেন। এমনি করে গরুকে কেন্দ্র করেই তার গোটা জীবনের মধ্যে একটা চোরা আবর্ত সৃষ্টি হলো।