দীলু বলল, নানা ঠিক আছে আমরা নতুন গরুটির নাম রাখলাম তরণী । ওকে তরণী নামেই ডাকব।
শেখ তবারক আলী বললেন, মাশাল্লাহ আমার ওই নাতনিটার বুদ্ধি-বিবেচনা। ভারি পরিষ্কার। তারপরে শেখ তবারক আলী বলে যেতে থাকলেন, বাংলাদেশে এই প্রজাতির গরু এই একটিই আছে। বাচ্চা অবস্থা থেকে চতুষ্পদ শিশুটির প্রতি অনেকেরই নজর ছিল। গ্লোব ইন্টারন্যাশনালের মালিক নব্য ধনী খলিলুল্লাহ সাহেব নীলামের সময় পঁচাশি হাজার পর্যন্ত উঠেছিলেন। শেখ তবারক এক লাফে আরো পাঁচ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়ে এই গো-কন্যাটিকে হস্তগত করেছেন তার মেয়ে এবং নাতনির জন্য। এই গরুটির দাম নব্বই হাজার টাকা। এই পরিমাণ টাকা নগদে শোধ করে তার ভ্রাতুস্পুত্রী এবং নাতনির জন্য গরুটা কিনেছেন। শুনে আবু জুনায়েদের মুখের হা-টা বড় হয়ে গেল। নুরুন্নাহার বানুর মুখে সহসা কোনো কথা জোগাল না। কেবল দীলু মন্তব্য করল,
–নানা আপনার দীলটা অনেক বড়।
–কত বড়, নাতনি বলো দেখি ।
–অনেক বড়, বঙ্গোপসাগরের মতো।
গরুর সেবা-যত্নের বিষয়ে কিঞ্চিৎ পরামর্শ দিলেন শেখ তবারক আলী। তিনি বললেন, গরুটিকে সব সময় না ঠাণ্ডা না গরম জায়গায় রাখতে হবে। শীতের দিনে কুসুম গরম পানি দিয়ে প্রতিদিন গোসল করাতে হবে। আবার গরমের দিনে শীতল পানিতে গোসল করাতে হবে। কম্বল মশারি এসব তো অবশ্যই প্রয়োজন। দেশী ঘাসে গরুটির ভীষণ অরুচি। শেখ তবারক আলী লাইভ স্টক ডিপার্টমেন্টের খামার থেকে নিয়মিত ঘাস সরবরাহের একটা আপাত বন্দোবস্ত করেছেন। ওই জাতীয় ঘাস বাড়ির পেছনে চাষ করানো যায় কি না পরীক্ষা করিয়ে দেখবেন। গরমের দিন যখন আসবে, একটা এয়ারকুলার সেট করার ইচ্ছেও তার মাথায় আছে। আরো কতিপয় বিষয়েকঞ্চিৎ উপদেশ দিয়ে শেখ তবারক আলী উঠে দাঁড়ালেন। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও নুরুন্নাহার বানু, আবু জুনায়েদ, দীলু তাকে এক চায়ের অধিক কিছু খাওয়াতে পারলেন না।
১০-১২. আবু জুনায়েদের দুলালি
আবু জুনায়েদের দুলালি দীলু একটা মস্ত কাণ্ড করে বসল। আবেদ হোসেনকে দিয়ে গোয়ালঘরের দরজায় একটা নেমপ্লেট লাগিয়ে দেয়া হলো। গরুটির যেহেতু তরণী নামকরণ করা হয়েছে, সুতরাং গোয়ালটির নাম হলো তরণী নিবাস। আরো কিছু কথা যোগ করার ইচ্ছে দীলুর ছিল- যেমন এই প্রজাতির গরু বাংলাদেশে এই একটিই আছে এবং গরুটির মা-বাবা উভয়েই শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ভুক্ত। বাবা অস্ট্রেলিয়ান, মা সুইডিশ। আবেদ হোসেন দীলুকে বুঝাতে সক্ষম হলেন, যে তার কোনোই প্রয়োজন নেই। গরুটি যে একবার দেখবে প্রথম দর্শনেই বুঝে যাবে এটা ভিন্ন জাতের গরু। বাংলাদেশের গরু সম্প্রদায়ের আত্মীয়স্বজন কেউ নয়; এই চতুষ্পদের বেটি। তারপরেও জাতীয়তার বিচারে তরণীকে বাংলাদেশী বলতে হবে, কারণ তার জন্মস্থান বাংলাদেশ। অন্য কেউ হলে দীলুকে অত সহজে নিবৃত্ত করা যেত না। তবে আবেদ হোসেনের কথা আলাদা। আবেদ ভাই দেখতে কী হ্যান্ডসাম। আমেরিকায় পড়াশোনা করেছেন, অথচ একটুও অহংকার নেই। কী রকম সপ্রতিভভাবে কথা বলেন। পাজেরোর স্টিয়ারিং হুইল ধরার ভঙ্গিটা কী চমৎকার। দীলুর তো ইচ্ছে করে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে একটু ঘুরে টুরে আসে।
তরণী, হ্যাঁ গরুটিকে এখন থেকে এ নামেই ডাকতে হবে। অস্ট্রেলীয় বাবার ঔরসে সুইডিশ মাতার গর্ভে যার জন্ম, বাংলাদেশের মাননীয় পশু বিশারদেরা দেশী নৌকার সঙ্গে যার আকৃতির সাদৃশ্য দেখতে পেয়ে এই চমৎকার নামটি দিয়েছেন, তার প্রতি সম্মান না দেখালে অন্যায় করা হবে। তরণী ‘তরণী নিবাসে’ আসার পর থেকে আবু জুনায়েদের পারিবারিক জীবনে নানারকম গণ্ডগোল ঘটতে আরম্ভ করল।
আবু জুনায়েদ অতিশয় কর্মব্যস্ত মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্প্রদায়, কর্মচারীমণ্ডলী, ছাত্রছাত্রীর কাছে কোথাও না কোথাও একটা ঘাপলা প্রতিদিন লেগেই আছে। কোথাও খুন হচ্ছে, কোথাও ভাঙচুর চলছে, মাইনে বাড়ানো, পরীক্ষা পেছানো এই জাতীয় কত রকমের দাবি বর্শার চকচকে ফলার মতো ধারালো হয়ে জেগে উঠছে। সরকারের মন্ত্রিমহোদয় চোখ রাঙাচ্ছেন, বিরোধী দলের নেতা হুংকার দিচ্ছেন, সবকিছুর দায়ভাগ শেষ পর্যন্ত আবু জুনায়েদকেই বইতে হয়। কোন্ দিক তিনি সামলাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন বাঁধা প্রশাসনিক কাজের পরিমাণও অল্প নয়। সামাল দিতে গিয়ে আবু জুনায়েদকে হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। তার উপর চারদিকে অসন্তোষ। তার নিজের দলটির শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগেই আছে। অনেক কিছুর আশায় যারা ডোরাকাটা দলে যোগ দিয়ে আবু জুনায়েদকে সমর্থন করেছিলেন, তাদের অনেকেই তার বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছেন। দল ছেড়ে যাবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধপক্ষের লোকেরা প্রচার করতে আরম্ভ করেছেন, প্রাক্তন উপাচার্য আবু সালেহ পাঁচ বছরে যে পরিমাণ অনিয়ম করতে পারেননি আবু জুনায়েদ পাঁচ মাসে তার দুগুণ করে ফেলেছেন। শুধু তার দলের শিক্ষকদেরই পদোন্নতি ঘটেছে। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তারাই হাতিয়ে নিয়েছেন, তাদের নামেই বাড়িগুলো বরাদ্দ হয়েছে। প্রভোস্ট, হাউস টিউটর থেকে শুরু করে দারোয়ান, মালি পর্যন্ত সবগুলো চাকরি আবু জুনায়েদের লোকেরা বাগিয়ে নিয়েছে। চারদিকের তাপ চাপে আবু জুনায়েদের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। আবু জুনায়েদের নিশ্বাস ফেলার ফুরসত মেলে না। সকালে মিটিং, দুপুরে মিটিং, সন্ধ্যেয় মিটিং। সবগুলো মিটিংয়ে তাকে প্রিসাইড করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও কোথাও নিজের মতামত আরোপ করতে পারেন না। প্রায় সময়ই আবু জুনায়েদকে নিজের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। মাঝে-মাঝে আবু জুনায়েদের মনে হয়, মাছঅলা তরকারিঅলার সঙ্গে দরাদরি করার সময় তিনি যে ব্যক্তিত্বের স্বাদ পেতেন, স্বাধীনতার যে উত্তাপ অনুভব করতেন, উপাচার্যের চেয়ারে বসার পর সেসব উধাও হয়ে গেছে। তিনি একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছেন। তিনি কিছুই করছেন না, তাকে দিয়ে করিয়ে নেয়া হচ্ছে। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই।