গরুটা থামের সঙ্গে বেঁধে লোক দুজন চলে গেছে। আবু জুনায়েদ এই নিরিবিলি মুহূর্তটিতে সম্মুখ পাছ নানা দিক থেকে দেখছিলেন। এই সময়ে একটি কণ্ঠস্বর শুনলেন ।
-স্যার বেয়াদবি মাফ করবেন। পারমিশন না নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম ।
তিনি তাকিয়ে দেখেন সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তারই বিভাগ অর্থাৎ রসায়ন শাস্ত্রের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর আধপাগলা মুস্তাফিজুর রহমান। আবু জুনায়েদ বিরক্ত হয়েছেন। যা হোক, সেটা গোপন করে বললেন,
-কী খবর মুস্তাফিজুর এত রাতে। মুস্তাফিজুর রহমান বললেন,
-স্যার প্রথমেই আপনাকে জানানোর জন্য ছুটে এসেছি। কাজটি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেই শুরু করেছিলাম। এই এতদিনে প্রবলেমটার একটা সলিউশন পাওয়া গেছে। এই যে দেখুন ইউ. এস. এ-র প্রিন্সটন য়ুনিভার্সিটি থেকে ড. রবার্টসন ফ্যাক্স করে জানিয়েছেন আমার সলিউশনটা কারেক্ট । এই লাইনে ড. রবার্টসন সর্বশেষ্ঠ অথরিটি। কেমিস্ট্রির ইতিহাসে এটা বড় ঘটনা ।
মুস্তাফিজ ফ্যাক্সের কপিটা আবু জুনায়েদের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, এই যে দেখুন । আবু জুনায়েদ কপিটা একবার দেখলেন বটে। কিন্তু পড়ে দেখার প্রবৃত্তি হলো না। মুস্তাফিজ সাহেবকে বললেন,
-মুস্তাফিজ আমি এখন অন্য চিন্তায় মগ্ন আছি। একটা গরু সংগ্রহ করেছি। ভালো জাতের গরু। মশার আক্রমণ থেকে গরুকে রক্ষা করার জন্য একটি বড়সড় মশারি কোথায় পাওয়া যায়, সে ব্যাপারটা নিয়ে ব্যস্ত আছি। কাল সকালে আপনার ফ্যাক্স পড়ে দেখব। ফ্যাক্সের কপিটা রেখে যেতে পারেন, না নিয়ে যান। কাগজ পত্রের ভিড়ে হারিয়ে যাবে।
মুস্তাফিজ হতাশ ভঙ্গিতে টলতে টলতে বাইরে চলে এলেন। ওই এত রাতে ভুল জায়গায় কেন এলেন? মনে ভীষণ অনুতাপ জন্মাতে লাগল ।
রাত সাড়ে দশটার সময়ে শেখ তবারক আলী উপাচার্য ভবনে এলেন। তিনি ছিপ নৌকোর মতো লম্বাটে একটি স্পোর্টস কারে চড়ে এসেছেন।
আবু জুনায়েদকে খবর দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গরুটাকে নানাদিক থেকে দেখছিলেন। বড় সুন্দর গরু, দেখে দেখে আশ মিটে না। আবু জুনায়েদ বিস্ময়ভরা মুগ্ধতার ভেতরে এতই ডুবে ছিলেন যে শেখ তবারক আলী কখন তার পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন, খেয়াল করতে পারেননি। শেখ তবারক কাঁধে হাত রাখলেন। তাকে দেখে চমকে উঠলেন। তবারক সাহেবের বদলে চাচা শব্দটি তার মুখে এসেই গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু ডাকা হলো না। মাথা ঝুঁকিয়ে কদমবুসি করার ইচ্ছেও তাকে দমন করতে হলো ।
শেখ তবারক আলী জিজ্ঞেস করলেন,
–গরু পছন্দ হয়েছে?
–বারে পছন্দ হবে না, এত সুন্দর গরু, জবাব দিলেন আবু জুনায়েদ।
–মা বানু এবং দীলুর পছন্দ হয়েছে?
–সেসব আপনি তাদের কাছ থেকে শুনবেন। চলুন উপরে যাই।
শেখ তবারক আলী আবু জুনায়েদের পিছে পিছে পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে সলেন, গোয়াল ঘরে না নিয়ে গরুটা এখানে বেঁধে রেখেছেন কেন?
–আবু জুনায়েদ জবাব দিলেন,
আপনার লোকটা বলল এই জাতের গরু অন্ধকারে থাকতে পারে না। তাই আজ রাতটা এখানেই রেখেছি।
–সে কি গোয়াল ঘরে কারেন্ট দেয়নি? শেখ তবারক আলী হতবাক হয়ে গেলেন। তারপর আক্ষেপের সুরে বললেন,
–এই সমস্ত ইডিয়টদের নিয়ে কাজ করে সুখ নেই। শেখ তবারক আলী আবু জুনায়েদের সঙ্গে উপরে এলেন। দীলু নানা এসেছেন, নানা এসেছেন বলে শোরগোল শুরু করে দিল। মজা করে শেখ তবারকের মাথা থেকে টুপিটা তুলে নিয়ে নিজের মাথায় দিল । তিনি আদর করে নাতনির চুল ধরে টানলেন, নাক এবং গাল টিপে দিলেন, বললেন,
টুপিতে নাতনিকে সুন্দর মানিয়েছে।
নুরুন্নাহার বানু এসে চাচাকে সালাম করলেন। শেখ তবারক তার ভ্রাতুস্পুত্রীর মাথায় হাত দিয়ে আদর করলেন, জিজ্ঞেস করলেন,
-কেমন আছ মা বানু?
নুরুন্নাহার বানু রাগত স্বরে বললেন,
–চাচা আপনার সঙ্গে কথা বলব না।
শেখ তবারক অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, কেন মা বানু পাগলি আমি আবার অন্যায়টা কী করলাম?
কথা বলব না তার প্রথম কারণ, আপনি আসবেন বলেছিলেন, আসেননি আর দ্বিতীয়টি থাক বলতে বলতে থেমে গেলেন।
শেখ তবারক আলী বললেন,
–এই তো মা আমি এসেছি, এখন দ্বিতীয় কারণটি বলো ।
–চাচা আপনি একটা গরু পাঠিয়ে মস্ত ফ্যাসাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন, ঘরে
আসতেই গরুর দাবি জমকালো মশারি চাই । দুদিন পর গরুর জাবনা এবং বিচালি খাওয়ার জন্য রূপোর গামলার দরকার হবে। এসব আমি যোগাব কেমন করে?
নুরুন্নাহার বানুর কথা শুনে শেখ তবারক আলী মৃদু হাসলেন।
-মা বানু, এই নতুন এসেছে, তাই ঝামেলা মনে হচ্ছে, দুদিন যাক গরুটাকে ভালো লাগতে আরম্ভ করবে। তবে এটা খুবই কুলীন জাতের গরু, যত্ন-আত্তি তো একটু করতে হবে। সকলের রাশিতে আবার গরু-ছাগল, পশুপাখি এদের বাড় বৃদ্ধি হয় না। পশুদেরও প্রাণের ভেতর থেকে ভালবাসতে হয়। অনাদর, অবহেলা, উপেক্ষা এরা মানুষের চাইতে ভালো বুঝতে পারে। পশুপাখির কথা বাদ দাও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, গাছপালাও অনাদর সহ্য করে না।
তারপর শেখ তবারক আলী গরুটার বংশবৃত্তান্ত বলতে আরম্ভ করলেন। সুইডিশ গাভী এবং অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়ের মধ্যে ক্রস ঘটিয়ে এই বাচ্চাটি জন্মানো হয়েছে। সরকারি লাইভস্টক বিভাগকে তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেকদিন থেকেই চেষ্টা করে আসছিলেন, একটি মাত্র সফল বাচ্চা জন্মানো সম্ভব হয়েছে। আর সেই বাচ্চাটি এখন বানুদের বাড়িতে এসেছে। ছিপ নৌকোর মতো লম্বা বলেই এই প্রজাতিটির নামকরণ করা হয়েছে তরণী।