.
০৯.
তিনি একটা আলো আনতে বললেন। দারোয়ান উপরে গিয়ে একটা চার্জার নিয়ে এল। এবার গরুর পুরো চেহারা সকলের নজরে এল। আবু জুনায়েদের ইচ্ছে হলো তিনি চিৎকার করে উঠবেন। কী অপূর্ব সুন্দর গরুটি। ছিপ নৌকার মতো লম্বা শরীর। গ্রীবাটি উন্নত। কপালে দুটো শিং বেরুতে গিয়ে থেমে গেছে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল লাল। মাঝে-মাঝে ডোরা কাটা দাগ। গরুটিকে পৌরাণিক বুররাকের মতো দেখাচ্ছে। যদি দুটি পাখা থাকত, তাহলে পশুটি আকাশের দিকে উড়াল দিত। ওলানটা অল্প-অল্প মধুভর্তি মৌচাকের মতো স্ফীত হওয়ার পথে। সবচেয়ে সুন্দর চোখ দুটি। একটা অসহায় ভাব দর্পণের মতো প্রতিফলিত হচ্ছে। লেজের চামড়াটা সাদা। গরুটা অসহায় এবং কৌতূহলী দৃষ্টি দিয়ে লোকজনের দিকে তাকাচ্ছে। অল্প অল্প নড়াচড়া করছে এবং চারপাশ ভালো করে দেখে নিচ্ছে। যখনই গরুটা নড়াচড়া করে গলার ঘণ্টি থেকে টুং টুং টুং আওয়াজ বেরিয়ে আসে। শিকলটা ঝন ঝন ঝন করে বেজে ওঠে। আবু জুনায়েদের সারা জীবনের স্বপ্ন কামনা একটি গরুর আকার ধরে মূর্তিমান হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুল না । তিনি অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে গরুটি দেখছিলেন।
নুরুন্নাহার বানু শিকল ধরে দাঁড়ানো লোকটির কাছে জানতে চাইলেন,
-আচ্ছা গরুর কাছে গেলে ভূঁসাতে আসবে না তো।
লোকটি উত্তর দিল,
-এ গরু কুঁসায় না। লাথি মারে না। ডরের কিছু নাই, যান কাছে যাইয়া আদর কইরা দেহেন।
নুরুন্নাহার বানু বললেন,
-থাক বাবা আমার সাহস হয় না। জানোয়ার তো কখন কী করে বসে।
নুরুন্নাহার বানুর মেয়েটি তার চাইতে সাহসী। সে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে গরুর গলায় হাত রাখল। গরুটি একটু ঘুরে গিয়ে লম্বা জিভ বের করে তার বাহু চাটতে আরম্ভ করল। মেয়েটির কাতুকাতু লাগছিল। দুপা পিছিয়ে এসে কলকণ্ঠে বলে উঠল,
-দেখো দেখো আলু গরুটি কেমন করে আমার বাহু চাটতে ছুটে আসছে।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-তুমি সরে এলে কেন, চাটতে দাও না। বোঝা যাচ্ছে গরুটির বেশ দয়াময়া আছে।
এবার উপাচার্য সাহেব এগিয়ে এসে গরুর পিঠে হাত রাখলেন। পশমের মতো সুন্দর কেশের স্পর্শসুখ অনুভব করলেন। গরুটি আবার আবু জুনায়েদের শরীরের অনাবৃত অংশ চাটবার জন্য জিভ বের করল। আবু জুনায়েদ পাঞ্জাবির আস্তিন গুটিয়ে নিয়ে হাতটি প্রসারিত করে দিয়ে বললেন,
-বেটি চাট।
আবু জুনায়েদের ইচ্ছে হলো ওলানটা একটু ধরে দেখবেন। স্ত্রী এবং কন্যার উপস্থিতিতে সেটা করা সঙ্গত হবে না মনে হওয়ায় বিরত থাকলেন। তিনি নানা জায়গায় হাত বুলিয়ে গরুর শরীরের উত্তাপ অনুভব করছিলেন। তার স্বামী একটা গরুকে নিয়ে লোকজনের সামনে এত আদিখ্যেতা করবেন, নুরুন্নাহার বানুর সেটা সহ্য হলো না। কণ্ঠস্বরে আঁজ মিশিয়ে বললেন,
-পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করলেই চলবে নাকি! গরুকে তার জায়গায় নিয়ে যাও। খেতে দেবে কী সে কথা চিন্তা করো ।
দড়ি ধরে থাকা লোকটি বলে বসল,
-একটা মশারির প্রয়োজন হবে। এই জাতের গরু মশার কামড় সহ্য করতে পারে না।
নুরুন্নাহার বানু বললেন,
-তুমি একটু ঠাণ্ডা হও, আমি দেখি কী করা যায় ।
তারপর তিনি ডাক দিলেন,
-ওই বুয়া শুনে যা।
বুয়া এলে বললেন,
-আজ রাতের জন্যে তোমার মশারিটা গরুটাকে দিয়ে দাও। কাল সকালে অন্য ব্যবস্থা করা হবে।
বুয়া বিড়বিড় করে বলল,
-মানুষটাকে মশায় খাউক কুনু চিন্তা নাই। গরুর বাচ্চারে মশারি লাগাইয়া দাও। মাইনষের বিচার।
কিন্তু সে আট-দশ জায়গায় তালিমারা নিজের মশারিটা এনে দিল। লোকটি এক ঝলক দেখেই বলে দিল।
-ওই মশারি ত তিন হাত লম্বা দুই হাত পাশ। গরুটা কত লম্বা জানেন, পৌনে পাঁচহাত চলবে না।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-আজকে কোনোরকমে থাকুক, কাল নতুন মশারির ব্যবস্থা করব ।
নুরুন্নাহার বানু চটে গেলেন । তিনি কোনো কথা ভেতরে রাখতে পারেন না। লোকজনের সামনেই বলে বসলেন,
-বাড়িতে পারা দিতেই নতুন মশারির দাবি। কাল সকাল হলে আরো কত কিছুর প্রয়োজন হবে। আবু জুনায়েদ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। নুরুন্নাহার বানুর কথাগুলো তবারক সাহেবের কানে গেলে তিনি অসন্তুষ্ট হতে পারেন। তিনি বললেন,
-আঃ তুমি চুপ করো। আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করব। ভাই আপনি গরুটা ওই দিক দিয়ে গোয়াল ঘরে নিয়ে যান। দারোয়ান গোয়ালঘরের বাতিটি জ্বালিয়ে দাও তো।
দারোয়ান বলল,
-স্যার গোয়াল ঘরে তো আলোর বন্দোবস্ত করা হয়নি। আবু জুনায়েদ এই। প্রথম শেখ তবারক আলীর ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটা ত্রুটি আবিষ্কার করলেন।
লোকটি বলল,
-স্যার এই জাতের গরু আন্ধাইরে থাকতে পারে না। আবু জুনায়েদ দিশেহারা হয়ে বললেন,–কী করব বাবা তুমিই বলে দাও। শুনলে তো গোয়াল ঘরে আলো নেই।
লোকটি বলল,
–আমি একুয়া কথা কমু আপনের মন লয় কি না চিন্তা করবেন।
আবু জুনায়েদ বললেন,
–হা বাবা বলো।
–আইজ রাইতে বড় দালানের বারান্দার একপাশে থাকুক।
আবু জুনায়েদ বললেন,
–ঠিক আছে বাবা ওই থামটার সঙ্গে বেঁধে রাখো।
নুরুন্নাহার বানু রেগে মেগে উপরে চলে গেলেন। কিন্তু মেজাজটা প্রকাশ করলেন না। মনে মনে বলতে থাকলেন, লোকটি বললে গরুটিকে নুরুন্নাহার বানুর বিছানায় শোয়াতে হবে, আবু জুনায়েদ চতুষ্পদের বাচ্চাকে তার খাটে উঠিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না।