-আজ বৃহস্পতিবার। আগামী কাল শুক্রবার। রাত আটটার পরে আমার লোক গরুটা নিয়ে আপনার বাড়িতে যাবে। আপনাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না। গরুর সঙ্গে খইল ভূষি কুড়া ঘাস সবই যাবে। যে লোক গরুর সঙ্গে যাবে সেই লোকটিই দেখাশোনার জন্য সেখানে থেকে যাবে। দক্ষিণ দিকের শেডটা সেজন্যই তৈরি করা হয়েছে। অনায়াসে বিছানা পেতে একজন মানুষ ঘুমোতে পারে। রাত সাড়ে নটা দশটার দিকে আমি এক ফাঁকে একবার দেখে আসব।
আবু জুনায়েদ অবাক হয়ে গেলেন। শেখ তবারক আলী মানুষটির বিশালতা ও সূক্ষ্ম চিন্তার পরিধি দেখে আবু জুনায়েদের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পাওয়ার মতো অবস্থা। যে সকল ভাবনা-চিন্তা আবু জুনায়েদের মনে একবারও উদয় হয়নি, শেখ তবারক আলী সেগুলো থরে থরে ব্যাখ্যা করে গেলেন। শেখ তবারক আলী যে তার স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুর আপন চাচার অধিক সে কথা তলিয়ে বিচার করবে কে? লোকে যখন জানবে ঠিকাদার শেখ তবারক আলী নুরুন্নাহার বানুকে জড়োয়া গয়নার সেট উপহার দিয়েছেন, মেয়েকে বেনারশি এবং সোনার ঘড়ি দিয়েছেন, আর সুন্দর একটি গোয়ালঘর বানিয়ে দিয়ে একটি মহামূল্যবান গরু পর্যন্ত সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, আবু জুনায়েদের প্রতি একান্ত সহানুভূতিশীল লোকদের মনও বিরূপ হয়ে যাবে। অলঙ্কার হোক, শাড়ি হোক, গোয়াল ঘর, গরু যাই হোক না সবকিছুর একটা নগদ অর্থমূল্য রয়েছে। কেউ যদি আপত্তি উঠিয়ে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন কাজে শেখ তবারককে অধিক সুবিধে দেয়ার জন্য আবু জুনায়েদ এসব ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তার আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো উপায় থাকবে না। কতিপয় প্রাক্তন উপাচার্যের কেলেঙ্কারির কাহিনীতে ঠিকাদারদের নাম যুক্ত হয়েছিল, আবু জুনায়েদ বিলক্ষণ সেসব অবগত আছেন। তারপরেও আবু জুনায়েদ জেনেশুনে ওই আড্ডার সঙ্গে পড়ে গেলেন। তার প্রতি লোমকূপ পর্যন্ত আঁৎকে শিউরে উঠল। লোকে শুনলে বলবে কী?
এই দুশ্চিন্তাটি মনে স্থায়ী হতে দিলেন না। শেখ তবারক আলী তাকে ঘুষ দেননি। তিনি কোনোরকম অর্থঘটিত কোনো কেলেঙ্কারি করবেন একথা স্বপ্নেও তার মনে উদয় হয়নি। মানুষ যা ইচ্ছে বলুক। আবু জুনায়েদের বিবেক পরিষ্কার। শেখ তবারক আলী এ পর্যন্ত উপহার গোয়ালঘর এবং গরুর পেছনে যে অর্থ ব্যয় করেছেন, তার পেছনে ঠিকাদারি স্বার্থসিদ্ধির কোনো মতলব নেই। তার জান্নাতবাসী শ্বশুর একসময়ে শেখ তবারক আলীকে জীবনের আসল বৃত্তিটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ শেখ তবারকের পয়সাকড়ির অন্ত নেই। তার থেকে সামান্য অর্থ যদি জান্নাতবাসী অগ্রজপ্রতিম গোফরান ভাইয়ের কন্যা এবং নাতনির পেছনে ব্যয় করে উপকারের প্রতিদান দিয়ে থাকেন, কার কী বলার থাকতে পারে? তারপরেও যদি কেউ খারাপ কথা বলে তার জবাব দেয়ার ক্ষমতা মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের আছে। তার যে একেবারে শিরদাঁড়া নেই, একথা ভাবা মোটেও ঠিক হবে না। সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। আগামী শুক্রবারে রাত আটটার পরে তবারক সাহেবের লোক গরু নিয়ে আসবে সংবাদটি নুরুন্নাহার বানুকে জানানো প্রয়োজন। যাতে নুরুন্নাহার বানু কোনো মেয়েলী ভুল করে না বসেন সেজন্য আগাম সতর্ক করে দেয়ার কথাটিও মনে রাখলেন।
শুক্রবার দিন সন্ধ্যা আটটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে আবু জুনায়েদ, নুরুন্নাহার বানু তাদের কন্যা দীলু গরুটাকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। আবু জুনায়েদ চাপা স্বভাবের মানুষ। নুরুন্নাহার বানু বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। তার সেই পুরনো কুসংস্কারটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। তার কোনো কাজ সহজে সম্পন্ন হয় না। কোথাও না কোথাও থেকে একটা বিঘ্ন এসে সব ভণ্ডুল করে ফেলে। তার মনে নানারকম সন্দেহ রেখাপাত করে যাচ্ছিল। কী তবারক চাচা গরুটা কিনতে পারলেন কি না। যদিও কিনে থাকেন, গাড়ি ঘোড়ার ভিড় দেখে ভয় পেয়ে ছিঁড়ে কোথাও যদি চলে যায়। দীলু মেয়েটির উচ্ছ্বাস ধরে না। একবার আবু জুনায়েদকে জিজ্ঞেস করে। একবার নুরুন্নাহার বানুকে,
-আব্বা গরুটা আসবে তো। এই তো আটটা বেজে গেল। কখন আসবে । শুধোশুধি আমি টি. ভি. প্রোগ্রামটা মিস করলাম।
নুরুন্নাহার বানু এত বড় ধিঙ্গি মেয়ের আদেখলেপনা দেখে একটা কিল উঠিয়েছিলেন আবু জুনায়েদ তার হাতটা চেপে ধরলেন। অতএব মেয়েটি কিল খাওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে গেল । ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটার ঘরে ঠেকেছে। আবু জুনায়েদ নিজেকেই প্রশ্ন করেন, কী ব্যাপার গরু আসে না কেন? এরকম তো হওয়ার কথা নয়। তবারক সাহেব এক কথার মানুষ এবং তার সময়জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, কোনো একটা অসুবিধে হয়েছে। আজ আর আসছে না।
এ সময়ে দারোয়ান এসে জানালো দুজন মানুষ একটা গরু নিয়ে এসেছে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সকলের। আবু জুনায়েদ, নুরুন্নাহার বানু, মেয়ে দীলু, ছোকরা চাকর, কাজের বেটি সকলে হুড়োহুড়ি করে নিচে নেমে এলেন। গরুসহ মানুষ দুজন ভেতরে প্রবেশ করল । সত্যি সত্যি একটা গরু উপাচার্য ভবনের কমপাউন্ডের মধ্যে প্রবেশ করল। আবু জুনায়েদের কামনার ধন গরু। নতুন গরু কিনলে গোয়ালে ঢোকাবার আগে কতিপয় আচার পালন করতে হয়। আবু জুনায়েদের তার একটাও মনে নেই। তিনি এত খুশি হয়েছেন যে হঠাৎ করে তার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরুচ্ছিল না। মানুষ দুজন গরুটাকে বোগেনভেলিয়ার ঝাড়ের নিচে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, ছায়াছায়া অন্ধকারে পুরো চেহারাটা কারো চোখে ধরা পড়ছিল না।