ডোরাকাটা দলে যেসব সিনিয়র শিক্ষক এসে যোগ দিয়েছিলেন, শুরুর দিকে সকলের বুলি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে হবে, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে এবং সর্বক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর জুনিয়র শিক্ষকদের যাতে তাড়াতাড়ি প্রমোশন হয় এবং তারা তাড়াতাড়ি বিদেশ যেতে পারেন সে ব্যবস্থাটিও নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো তো হলো নির্বাচনী দাবি। কিন্তু প্রার্থী মনোনয়নের বেলায় একটা মস্ত ঘাপলা দেখা দিল।
এবারের নির্বাচনে ডোরাকাটা দলের জয়লাভ করার সমূহ সম্ভাবনা। এই দলের ভেতর থেকে তিনজন যোগ্য ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়ে তিনজনের একটি প্যানেলকে মনোনয়ন দিতে হবে। এই তিনজনের প্যানেল ঠিক করার সময় শুরু হলো আসল গণ্ডগোল। সাম্প্রতিককালে প্রায় বার জন ঝুনো প্রফেসর ডোরাকাটা দলের সমর্থক। তাদের প্রত্যেকেই মনোনয়ন পেতে ভীষণ রকম আগ্রহী। সকলেই মনে করেন, তার মতো যোগ্য প্রার্থী পূর্বে কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। প্রায় সকলেই মনে করেন বিশ পঁচিশ বছর ধরে শিক্ষকতার মহান ব্রতে নিযুক্ত আছেন, অবসর নেয়ার পূর্বে উপাচার্যের চেয়ারটিতে একটা পাছা ঠেকাতে পারলে নিঃস্বার্থ জ্ঞান সেবার একটা স্বীকৃতি অন্তত মিলে। এই জ্ঞানবৃদ্ধ মহান শিক্ষকদের মধ্যে এ নিয়ে এত ঝগড়াঝাটি হতে থাকল যে সকলে আশঙ্কা পোষণ করতে লাগলেন ডোরাকাটা দলটিই না আবার তিন টুকরো হয়ে যায় । আগের জমানা হলে তলোয়ার দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাথা কেটে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করতেন। কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার হলো নিজে নিজে ঘোষণা করে প্যানেলভুক্ত প্রার্থী হওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য দলের স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়। দলের কর্তা ব্যক্তিদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তারা কিছুতেই সিনিয়র শিক্ষকদের একটা আপস মীমাংসায় টেনে আনতে পারলেন না। দিনে রাতে মিটিং করেও কোনো গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা বের করা সম্ভব হলো না। বুড়ো প্রফেসররা নিজ নিজ অবস্থান এমন দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে রইলেন যে বিরক্ত জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের কাছে যাওয়া আসা ছেড়ে দিয়ে যার যার ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করছিলেন। সকলে আবার বলাবলি করতে থাকলেন আবু সালেহ্ আরো এক টার্মের জন্য উপাচার্য থেকে যাবেন। ডোরাকাটা দলটাকে বুড়ো প্রফেসররা পাংচার করে দিয়েছেন। সুতরাং আবু সালেহর দল এবারও বিনা বাধায় নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছে। ডোরাকাটা দল পনের দিনব্যাপী ঝগড়াঝাটির কারণে ভেঙে চার টুকরো হয়ে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু দিলরুবা খানম এবারেও তার ম্যাজিকটা অব্যর্থভাবে প্রয়োগ করলেন ।
তিনি রিকশা করে তরুণ শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে এনে জড়ো করলেন। দলীয় ঐক্যটাকে ভেতর থেকে মজবুত করে তুললেন। তারপর তরুণ শিক্ষকদের দিয়ে ঘোষণা করালেন যে সমস্ত সমর্থকদের দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। যিনি স্বেচ্ছায় মেনে নেবেন না তাকে দল থেকে বের করে দেয়া হবে। এই ঘোষণাটা ভয়ানকভাবে কাজ দিল। জ্ঞানবৃদ্ধ প্রফেসরদের আস্ফালন আপনা থেকেই থেমে গেল। এত পানি ঘোলা করার পরে আবু সালেহর দলে গিয়ে যে জুটবেন, সে পথও খোলা নেই। অগত্যা দলীয় সিদ্ধান্তের জন্য চুপ করে অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর রইল না। ডোরাকাটা দলের সমর্থকেরা বৈঠকের পর বৈঠক করে প্যানেলের জন্য দুজন মানুষকে বেছে নিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজে তাদের মোটামুটি সুনাম আছে। তারা প্রতিপক্ষকে খুন করে নিজেরা মনোনীত হওয়ার উগ্র আকাঙ্ক্ষা বিশেষ ব্যক্ত করেননি। দুটি নাম তো পাওয়া গেল। কিন্তু তৃতীয় নামটির বেলায় তারা মস্ত ফাঁপড়ে পড়ে গেলেন। সমস্ত ডোরাকাটা দলে আর একটিও মানুষ নেই, যাকে মনোনয়ন দিলে দলে বিতর্ক সৃষ্টি হবে না। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে মনোনয়ন দিলে কোনো বিতর্ক হতো না, এটা সকলেই জানতেন। কিন্তু তার কথা একটিবারও কারো মনে আসেনি। তিনি প্রফেসর বটে, বিদেশের নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ডিগ্রিও আছে। ছাত্রী কিংবা সহকর্মী কাউকে নিয়ে লটরটর করার অপবাদও কেউ তাকে দিতে পারবেন না। পরীক্ষার খাতা দেখার বেলায় তিনি মোটামুটি নিরপেক্ষতা মেনে চলেন। ডোরাকাটা দলের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও তার নাম কারো মনে আসেনি, কারণ তার মতো গোবেচারা মানুষের নাম উপাচার্যের জন্য বিবেচিত হতে পারে, এটা কেউ স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারেননি। এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছিল। আজা কর রাতটাই সময়। আগামী কাল সকাল দশটার মধ্যে তিনজন প্রার্থীর প্যানেল ঘোষণা দিতে হবে। তারপর নির্বাচন হবে। তৃতীয় নামটির জন্য দলের মধ্যে আবার উৎকণ্ঠা ঘনীভূত হয়ে উঠল। একজন প্রবীণ শিক্ষক তো মন্তব্যই করে বসলেন, চলুন ফেরা যাক। এবারেও আবু সালেহর কাছে আমরা হেরে গেলাম। ডোরাকাটা দলের ভাগ্য চিকন সুতোয় ঝুলছিল। এই শেষ মুহূর্তটিতে দিলরুবা খানম আবার ত্রাণকর্তীর বেশে এসে দেখা দিলেন। প্রবীণ শিক্ষক ড. সারোয়ারের মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে বললেন, আমরা আবু সালেহর কাছে হার মানব কেন, আর ফিরেও যাব কেন । দিন এক টুকরো কাগজ, আমি
তৃতীয় প্রার্থীর নাম লিখে দিচ্ছি। তারপর নিজে ভ্যানিটি ব্যাগের চেন খুলে ডায়েরি বের করে একটা বাতিল খাতা ছিঁড়ে একটানে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের নামটা লিখে দিয়েছিলেন। পড়ে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। দুয়েকজন হাসি চাপতে পারলেন না। ড. সারোয়ার মহা বিরক্ত হয়ে বলে বসলেন, এটা কী করলেন? দিলরুবা খানম চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, এটা হলো গিয়ে আপনার তিন নম্বর নাম। আমাদের তিনটি নামের একটি প্যানেল দেয়ার কথা। সে তিনটি নাম পুরো হলো। আর কোনো কথা নয়। এখন যে যার ঘরে চলে যেতে পারেন। সকলে এত ক্লান্ত এবং বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে আর কথা বাড়ানো উচিত মনে করলেন না।