.
০৩.
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির ছিল গৌরবময় অতীত। অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোটা দেশের আত্মার সঙ্গে তুলনা করে গর্ব বোধ করতেন। এখানে মহান ভাষা আন্দোলন জন্ম নিয়েছে। যুগ যুগ ধরে অবদমিত ইতিহাসের উষ্ণ নিঃশ্বাসের মতো এখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগুন সমগ্র ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তি সংগ্রামের জ্বালামুখ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়।
অতীতের গৌরব গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। সাম্প্রতিককালে নানা রোগব্যাধি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কাবু করে ফেলেছে। মাছের পচন যেমন মস্তক থেকে শুরু হয়, তেমনি যাবতীয় অসুখের জীবাণু শিক্ষকদের চিন্তা চেতনায় সুন্দরভাবে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বরজারি, ধনুষ্টঙ্কার নানা রকমের হিস্টিরিয়া ইত্যাকার নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাধিগুলো শিক্ষকদের ঘায়েল করেছে সবচাইতে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বারশ শিক্ষক। এখন শিক্ষকসমাজ বলতে কিছু নেই। আছে হলুদ, ডোরাকাটা, বেগুনি এসব দল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কজা করার জন্য দলগুলো সম্ভব হলে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতো। মাঠ এবং রাস্তা ছাত্ররা দখল করে রেখেছে বলে শিক্ষকদের লড়াইটা স্নায়ুতে আশ্রয় করে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে বেশি প্যাচাল পাড়লে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের উপাচার্য হওয়ার উপাখ্যানটি অনাবশ্যক লম্বা হয়ে যায়।
সেই বছরটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে ডোরাকাটা দলটি নির্বাচিত হওয়ার খুবই সম্ভাবনা ছিল । আৰু জুনায়েদের সঙ্গে এই দলের একটা ক্ষীণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আবু জুনায়েদ নির্বিরোধ শান্তশিষ্ট মানুষ। দলবাজি তার মতো ধাতের মানুষের পোষায় না। তারপরেও আবু জুনায়েদ কীভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন। বলা যেতে পারে আবু জুনায়েদের ভাগ্য তাকে দলের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল । তথাপি পেছনে ছোট্ট একটা কাহিনী আছে। রসায়ন বিভাগের অবিবাহিতা সুন্দরী শিক্ষিকাটি পুরুষ মানুষদের সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলে বিরক্ত হয়ে গেলে অধিক উত্তেজনাপূর্ণ কোনো কিছুর মধ্যে নিজেকে ঢেলে দিতেন। এরকম ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। ভদ্রমহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে যে উপাচার্য ভদ্রলোকটি আসীন আছেন, তার পেয়ারের এক সুদর্শন শিক্ষকের প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিলেন। সকলকে বলাবলি করতে শোনা যেত এবার দিলরুবা খানমের একটা হিল্লে হয়ে যাবে । হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই, ভদ্রলোক শিল্প মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারির অল্প বয়েসী এক কন্যাকে বিয়ে করে ফেললেন। এই ঘটনাটি দিলরুবা খানমকে এক রকম ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। তিনি সপ্তাহখানেক ক্লাসে আসেননি। আঘাতের ধকলটা হজম করতে একটু সময় নিয়েছিল। পরে দিলরুবা খানম জেনেছিলেন ওই সেক্রেটারি ভদ্রলোকের সঙ্গে উপাচার্যের কী ধরনের আত্মীয়তা ছিল। তিনিই বিয়েটা ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। দিলরুবা খানমের সমস্ত ক্ষোভ রাগ ওই উপাচার্যকে উপলক্ষ করে ফুঁসে উঠতে থাকল । তিনি সর্বত্র বলে বেড়াতে লাগলেন এই দুর্নীতিবাজ আবু সালেহকে আসন থেকে টেনে ফেলে না দিলে এই বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে যাবে। উপাচার্য ছিলেন হলুদ দলের মনোনীত প্রার্থী। হলুদ দল ছাড়া বাদামি দলের শিক্ষকেরাও তাকে সমর্থন করতেন। দিলরুবা খানম কিছুদিনের মধ্যে একটা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললেন। হলুদ দলের সমর্থক বাঘা শিক্ষকদের ডোরা কাটা দলে নিয়ে এলেন। দিলরুবা খানমের মুখে ওই এক কথা। বর্তমান উপাচার্য অথর্ব, অশিক্ষিত, দুর্নীতিবাজ। তাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাস গজাবে না। অবশ্য বাঘা বাঘা শিক্ষকেরা একেবারে নিজের নিজের কারণে ডোরা কাটা দলে যোগ দিয়েছেন। বর্তমান উপাচার্য নিজের পেটোয়া লোক ছাড়া কারো প্রত্যাশা পূরণ করেননি। এই দলছুট শিক্ষকদের কেউ আশা করেছিলেন, উপাচার্য সাহেব তাকে একটা চার রুমের ফ্ল্যাট বরাদ্দ করবেন। কেউ আশা করেছিল, বিদেশ যাবার সুযোগ দেবেন। কেউ প্রত্যাশা করতেন তার আদরের দুলালীটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাবে। কিন্তু মুহম্মদ আবু সালেহ একে ওকে সবাইকে নিরাশ করেছেন। তাই তারাও একে একে ক্ষমতার বলয় থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। দিলরুবা খানমের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে কোনো মহিলা শিক্ষককে এমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। তরুণ শিক্ষকদের অনেকে মনে করতেন, শিক্ষক বাহিনীতে একজন মহিলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় শিক্ষক রাজনীতিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ হলো । দেশের প্রধানমন্ত্রী মহিলা, বিরোধী দলীয় নেত্রী মহিলা, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতিতেও একজন মহিলা যদি নেতৃত্ব দিতে ছুটে আসেন এই চরাচরপ্লাবী নারী জাগরণের যুগে এই ঘটনাটিকে অত্যন্ত সঙ্গত ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে হবে।
সুন্দরী মহিলার স্বভাবের খুঁত, দুর্বলতা যখন প্রকাশ পায় তখন তার পুরুষ মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা অনেক গুণ বেড়ে যায়। বেচারী আবু জুনায়েদ তার সুন্দরী এবং স্মলিতস্বভাবা সহকর্মী মহিলাটির আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে ডোরাকাটা দলের সমর্থকে পরিণত হয়েছিলেন। শুধু একজন নীরব সমর্থক, তার বেশি কিছু হওয়ার ক্ষমতা মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে আবু জুনায়েদের ধর্মপত্নী রাতের বেলা তার পাশে ঘুমিয়ে মনের মধ্যে যে সন্দেহটি নাড়াচাড়া করতেন, সেটি একেবারে অমূলক নয়। আবু জুনায়েদ যদি দিলরুবার টানে আকৃষ্ট হয়ে ডোরাকাটা দলে যোগ না দিতেন তার উপাচার্য হওয়ার প্রশ্নই উঠত না। তাহলে একথা থেকে আরেকটি কথা বেরিয়ে আসে। আবু জুনায়েদের স্ত্রী নুরুন্নাহার বানু সকলের কাছে যে দাবি করে বেড়াচ্ছেন, তার ভাগ্যে আবু জুনায়েদের ভাগ্য খুলেছে সেটা সত্যি নয়। এতে দিলরুবা খানমের হাত ছিল। আবু জুনায়েদের উপাচার্য হওয়ার ঘটনাটিকে যদি আল্লাহর কেরামত বলে মেনে নিই, আমরা বেহুদা কল্পনা করার কষ্ট থেকে রেহাই পেয়ে যাই। আল্লাহ নুরুন্নাহার বানুর খসম আবু জুনায়েদকে উপাচার্য বানাবার জন্য দিলরুবা খানমের হাবুডুবু খাওয়া প্রেমকে নষ্ট করে দিয়ে তাকে শিক্ষক রাজনীতিতে টেনে এনেছিলেন। শুধু এটুকু বললে আল্লাহর লীলাখেলার সূক্ষ্ম কেরামতির কথা সঠিকভাবে বর্ণনা করা হয় না। আল্লাহ যে বিশ্বজগতের সমস্ত রহস্য নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং তার ইঙ্গিতে যে সবকিছু ঘটে, সেটা প্রাঞ্জলভাবে উপলব্ধি করার জন্য আরো কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন।