শেখ তবারক আলীর নিশ্বাস-প্রশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। শরীরের কাঁপুনিও অনেকটা কমেছে। কিন্তু চোখ থেকে আতঙ্কের ভাবটা এখনো কাটেনি। যা হোক, কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি পুরোপুরি বোধশক্তি ফিরে পেলেন। এই অবস্থায় তাকে সুসজ্জিত অফিসে দেখে তিনি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। ঝোঁকের বশে তিনি একপায়ে জুতো নিয়ে উপাচার্যের অফিসে চলে এসেছেন। বাকি একপাটি জুতো কোথায় ফেলে এসেছেন বলতে পারেন না। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন
আপনি বিচলিত হবেন না। কী হয়েছে বলুন-
স্যার এই মাত্র আমার একজন ওভারসীয়রের ডান পায়ে গুলি করা হয়েছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দিচ্ছে না। এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকা ক্যাশ তাদের হাতে তুলে না দিলে, তারা আহত ওভারসীয়রের কাছে কাউকে ঘেঁষতেও দিচ্ছে না। এই মুহূর্তে আমার হাতে অত টাকা নেই। অনেক কাকুতিমিনতি করেছি। কোনো কথাই কানে তুলছে না। বেচারী বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। এই হারে রক্তপাত চলতে থাকলে মারা যাবে । আপনারা দয়া করে কিছু একটা করুন।
সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ড : শামসুল হুদা জিজ্ঞেস করলেন—
আপনি পুলিশকে জানাননি?
পুলিশকে জানাব কি? পুলিশের চোখের সামনেই তো তারা ওভারসীয়রকে টেনে নিয়ে ডান পায়ে গুলি করেছে এবং ঘোষণা দিয়েছে আড়াইটার মধ্যে যদি তাদের দাবি না মেটাই তাহলে তারা বাম পায়েও গুলি করবে। আমাকেও খোঁজাখুঁজি করছিল কিন্তু পালিয়ে আসতে পেরেছি।
পুলিশ যেখানে কিছু করছে না, আমরা কী করতে পারি? আমাদের এখতিয়ারে তো আর এমন সৈন্য-সামন্ত নেই যে, মস্তান-গুণ্ডাদের ঠেকাতে পারি। আপনি আইজির কাছে যান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যান, প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে নালিশ করুন, তারা একটা বিহিত করবেন। আমরা কী করব, কী করতে পারি?
ড. হুদার এই বক্তব্যের জবাবে শেখ তবারক আলী অনেক কথা বলতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন আইজির কাছে গেলে আইজি বলবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কিছু ঘটলে সেখানে পুলিশের নাক গলানোর অধিকার নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ৩ দিনে পাওয়া যাবে না। তার মতো একজন সামান্য ঠিকাদার কী করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। সেসব কিছুই উল্লেখ না করে বললেন-স্যার একজন মানুষের জীবন, আপনারা এ মুহূর্তে কিছু না করলে ছেলেটা মারা যাবে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে সরাসরি উপাচার্যের পা দুটো চেপে ধরলেন।
আহ্ করেন কী বলে আবু জুনায়েদ তিড়িং করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আবু জুনায়েদের কাছ থেকে যে আচরণ স্বপ্নেও কেউ আশা করেননি তাই করে বসলেন। তিনি বললেন–
হুদা সাহেব দয়া করে আমার সঙ্গে চলুন, বজলু সাহেব আসুন, একজন মানুষ মারা যাচ্ছে কী করে আমরা চুপ করে থাকতে পারি।
স্যার ওই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তো সব সময়েই মানুষ মারা যাচ্ছে, কী করতে পেরেছি আমরা? গেলে আমাদেরও তো গুলি করতে পারে। তাদের দাবি টাকা, ভালো কথা শুনবে কেন?
আবু জুনায়েদ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, রাখেন হুদা সাহেব আপনার দার্শনিক বক্তব্য। আমাদের কিছু একটা এ মুহূর্তে করতে হবে। তারপর তিনি গট গট করে হেঁটে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। সেই সভায় আগত মাননীয় ডীনদের সকলকে অগত্যা আবু জুনায়েদের পিছু পিছু আসতে হলো। উপাচার্যের অফিসের পিয়ন, চাপরাশি, দারোয়ান, কেরানী থেকে শুরু করে সমস্ত অফিসার কেউ কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে, কেউ চাকরিগত বাধ্যবাধকতার কারণে আবু জুনায়েদকে অনুসরণ করলেন। বের হবার আগে আবু জুনায়েদ ব্যক্তিগত সহকারীকে হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বললেন। সকলে বেরিয়ে যাচ্ছেন, অথচ শেখ তবারক আলী চৌকাঠ ধরে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আবু জুনায়েদ শেখ তবারককে উদ্দেশ্য করে বললেন
একি আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন যে। শেখ তবারক আবার আবু জুনায়েদের পা ধরতে উদ্যত হলেন। আবু জুনায়েদ একটু সরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন–
আপনি এসব করেন কী?
স্যার আপনাদের সঙ্গে আমাকে দেখলে মনে করবে আমি আপনাদের ডেকে নিয়ে এসেছি। তারা চটে গিয়ে আমার বাড়িতে হামলা করবে। আমার পুত্র কন্যাদের খুন করে ফেলবে।
সেদিন আবু জুনায়েদের হস্তক্ষেপে ওভারসীয়রটি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি আহত ব্যক্তিকে অবস্থা আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার আগে হাসপাতালে পাঠাতে পেরেছিলেন। আবু জুনায়েদের শত্রুরাও স্বীকার করেন এটা আবু জুনায়েদের একটা সাহসী কাজ। এই কাজটি কেন তিনি করতে পেরেছিলেন, আবু জুনায়েদের একটি নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। তিনি যখন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন, এভাবে যুক্তি দাঁড় করান। শেখ তবারক আলী সেদিন ইচ্ছে করলে তার মান-সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিতে পারতেন। তিনি ফাঁস করে দিতে পারতেন আবু জুনায়েদ শ্বশুরের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। বলতে পারতেন একেবারে সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবার থেকে তিনি এসেছেন। আবু জুনায়েদের জীবন বৃত্তান্ত যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তার সহকর্মীদের কাছে অজানা এটা মোটেও সত্যি নয়। এখানে সকলে সকলের হাঁড়ির খবর জানেন। প্রকৃত সত্যটা অনেক সময় রঙচঙে হয়ে প্রকাশ পায়। আবু জুনায়েদের বিপক্ষের লোকেরা তার নামে সাম্প্রতিককালে যে অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তার সঙ্গে প্রকৃত তথ্যের অনেক গড়মিল আছে। বিরুদ্ধবাদীরা বলে থাকেন, আবু জুনায়েদ অন্যের টাকায় পড়াশোনা করেছেন, একথা সঠিক। কিন্তু তিনি মেয়েটিকে বিয়ে না করে কন্যার পিতা ভদ্রলোককে প্রতারিত করেছেন। যা হোক, আবু জুনায়েদ মনে করেন শেখ তবারক তার একটা উপকার করেছেন। তিনি ওভারসীয়রকে হাসপাতালে পাঠিয়ে একটু প্রত্যুপকার করেছেন মাত্র। তার সঙ্গে সাহস মহানুভবতা ওসবের কোনোই যোগ নেই।