মাওলানা আবদুর রহমান তালিবের দ্বিতীয় প্রস্তাবটি শুনে একদিকে যেমন আবু জুনায়েদের হাসি সংবরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো তেমনি অন্যদিকে ভীষণ রাগ হচ্ছিল। তিনি মাওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন :
–মহিলারা ম্যানাস্ট্রসনের প্যাড কোথায় ফেলবেন, তাও আমাকে পাহারা দিতে বলেন? সেটাও কি উপাচার্যের কাজ? মাওলানা সাহেব বললেন, আপনি অকারণে রেগে যাচ্ছেন। আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি একটা নোটিশ লটকে দিন। এই রাস্তার পাশে পুরিন্দা ফেলা বেআইনী এবং অনৈসলামিক। এই পথ দিয়ে অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান যাতায়াত করে থাকেন। পুরিন্দার কারণে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং অনেক সময় তামাম শরীর অপবিত্র হয়ে যায়। যারা পুরিন্দা ফেলে যায়, আখিরাতে তাদের আজাব ভোগ করতে হবে ।
.
০৬.
শেখ তবারক আলীর সঙ্গে আবু জুনায়েদের পরিচয় ঘটল। এটা তার উপাচার্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর সবচাইতে স্মরণীয় ঘটনা। তবারক আলী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদার। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর মহিলা ছাত্রীনিবাসের নির্মাণ কাজ দেখতে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত কানপুরি টুপি মাথায় এক ধোপদুরস্ত বুড়োমতো ভদ্রলোক এগিয়ে এসে তাকে সালাম দিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের মুখে অল্প অল্প দাড়ি। একহারা দীঘল চেহারা। বয়েস হলেও ভদ্রলোক শিরদাঁড়ার উপর ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন। এই দাঁড়ানোর ভঙ্গি ছাড়া আরো দুটো জিনিস আবু জুনায়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। একটা হলো ভদ্রলোকের তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। অন্যটা গলার আওয়াজ। এমন শান্ত অনুত্তেজিত কণ্ঠস্বর আবু জুনায়েদ কখনো শুনেছেন মনে পড়ে না।
তবারক সাহেবের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভদ্রলোক বলতে আরম্ভ করলেন। তিনি এবং আবু জুনায়েদের স্বর্গগত শ্বশুর, আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন, একই সময়ে ঠিকাদারী ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। বলা যেতে পারে আবু জুনায়েদের শ্বশুর সাহেবই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তবারক আলীকে ঠিকাদারী পেশায় টেনে এনেছিলেন। কর্মজীবনে তার কাছে এক পয়সা মূলধন ছিল না। মরহুম আব্দুল গোফরানের লোক চেনার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। একবার চোখের দেখা দেখেই ঠিক ধরে নিতে পারতেন, কে কাজের মানুষ, কে ফালতু। আর জুনায়েদের শ্বশুর সাহেব কপর্দকহীন শেখ তবারক আলীকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র সংকোচ করেননি। আজকে যে তিনি ছেলে মেয়ে নিয়ে আল্লাহর রহমতে দুটো নুন-ভাত খেয়ে জীবন চালাতে পারছেন, তার পেছনে গোফরান ভাইয়ের মস্ত একটা ভূমিকা রয়েছে। যতদিন জীবিত ছিলেন, তিনি গোফরান সাহেবকে আপন মায়ের পেটের বড় ভাইয়ের চাইতেও অধিক শ্রদ্ধা-সম্মান করে এসেছেন। তবারক সাহেব আবু জুনায়েদের স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুকে আপন মেয়ের মতো জ্ঞান করেন। মরহুম গোফরান ভাই কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তার একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে নুরুন্নাহার বানুর পাত্র নির্বাচন করার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেন। কত বড় বড় খানদানি পরিবারের ছেলের সঙ্গে বানুর মানে নুরুন্নাহারের বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। গোফরান ভাই এক কথায় সবাইকে বিদেয় করে বানুর পাত্র হিসেবে আবু জুনায়েদকে পছন্দ করেছিলেন। আজকে যদি গোফরান ভাই জীবিত থাকতেন, নিজেই দেখতে পেতেন, তার পছন্দ কত সঠিক ছিল। বানুর বর আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন। তার দুচোখের কোণা চিকচিক করে উঠল। বুঝি তখনই কেঁদে ফেলবেন। আবু জুনায়েদের ভীষণ ভয় করতে লাগল। এই তবারক বেটা তাহলে তার বিষয়ে সবকিছু জানে। তার স্বর্গগত পাতানো বড় ভাইয়ের মহিমা কীর্তন করতে গিয়ে যদি বলে বসেন, আবু জুনায়েদ শ্বশুরের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে লেখাপড়া করেছেন তাহলে লোকজনের সামনে তার মাথাটা কাটা যাবে। তার হৃদয়স্পন্দন দ্রুত হলো, বুক দুরুদুরু করতে থাকল।
শেখ তবারক আলীকে কিছু একটা বলে কথার মোড় ঘুরিয়ে দেবেন সে রকম কোনো বিষয়ও তিনি খুঁজে পেলেন না। আবু জুনায়েদের পা দুটো মাটির সঙ্গে গেঁথে যাচ্ছিল। ঠোঁট শুষ্ক হয়ে আসছিল। বারবার তিনি জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছিলেন। অবশেষে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। শেখ তবারক আলী জানালেন, তিনি মরার আগে বানুর স্বামীকে উপাচার্যের আসনে দেখে গেলেন এটাই তার সান্ত্বনা। তবারক আলীর প্রতি আবু জুনায়েদের মনোভাবটাই পাল্টে গেল। তবারক আলী ইচ্ছে করলে মাত্র একটি বাক্য উচ্চারণ করে আবু জুনায়েদের মান ইজ্জত ধুলোয় লুটিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি কথাটি বলেননি। আবু জুনায়েদ তবারক আলীকে অত্যন্ত মহানুভব মানুষ মনে করলেন। ছাত্রীনিবাসের নির্মাণ কাজ দেখে ফিরে আসার সময় তিনি শেখ তবারক আলীকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন। শেখ তবারকও সেই নিমন্ত্রণ কবুল করেছিলেন।
তারপর সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে আবু জুনায়েদের সঙ্গে শেখ তবারক আলীর মুলাকাত ঘটল। একদিন তিনি তার অফিসে ফ্যাকাল্টির ডীনদের নিয়ে বহিরাগত মস্তানদের উৎপাত ঠেকানোর উপায় উদ্ভাবন করার বিষয়ে মিটিং করছিলেন। মিটিং চলাকালীন সময়ে একেবারে দরজা ঠেলে শেখ তবারক অফিস কক্ষে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এবং বললেন আমাকে বাঁচান। তার চুল উষ্কখুষ্ক। পাজামার অর্ধেক কাদায় ভরে গেছে। শরীর থরথর করে কাঁপছিল। মুখ দিয়ে ঠিকমতো স্বর বেরুচ্ছিল না। ঠিকাদার সাহেবের এই করুণ অবস্থা দেখে সকলে ভীষণ হতবাক হয়ে গেলেন। আলোচনায় আপনাআপনিই ছেদ পড়ে গেল। সকলেই উৎকণ্ঠাসহকারে জানতে চাইলেন, কী ঘটেছে? শেখ তবারক আলী বললেন, তিনি পানি খাবেন। এক গ্লাস পানি এনে তাকে দেয়া হলো। সবটা পানি নিঃশেষ করার পর বললেন, আরো এক গ্লাস পানি। আরো এক গ্লাস তাকে দেয়া হলো, তারপর আরেক গ্লাস।