তিনি তার বক্তৃতার এক জায়গায় বলে বসলেন, কাজী নজরুল ইসলাম যদি : দীর্ঘকাল সুস্থ থাকতে পারতেন তিনিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নোবেল প্রাইজটি পেয়ে যেতেন। হিন্দুরা ষড়যন্ত্র করে নজরুলের মাথাটি খারাপ করে দিয়েছিল, তাই তার ভাগ্যে নোবেল পুরস্কারটি জোটেনি।
নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আবু জুনায়েদ জাতীয় কবির সম্মান বৃদ্ধি করার জন্য যে অপূর্ব বক্তৃতা দিলেন, শুনে সরকারের চামচা কবিরা পর্যন্ত প্রমাদ গুনলেন। তারা তাদের সম্মেলনটির ওজন বৃদ্ধি করার জন্য উপাচার্য আবু জুনায়েদকে আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন। আবু জুনায়েদ নজরুলকে বড় করে দেখাতে গিয়ে পূর্বাপর সম্পর্করহিত একটা বেঁফাস মন্তব্য করে তাদের গোটা সম্মেলনটাকে খেলো করে দিলেন। সভার শেষে ড. (কবি) মনিরুল আলম আবু জুনায়েদকে উদ্দেশ্য করে বললেন :
-স্যার নজরুলের ব্যাপারে এই অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্যটি না করলেও পারতেন।
-কোন্ মন্তব্যের কথা বলছেন। আবু জুনায়েদের কণ্ঠে ঈষৎ বিরক্তির সুর।
-আপনি যে বলেছেন নজরুল সুস্থ থাকলে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতেন এবং হিন্দুরা ষড়যন্ত্র করে তার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল।
-অন্যায় কী বলেছি। একজন কামেল এবং বুজুর্গ মানুষের কাছ থেকে আমি শুনেছি হিন্দুরা ষড়যন্ত্র করে নজরুলের মাথাটি খারাপ করে দিয়েছিল। শাহ্ সুফী খান বাহাদুর মরহুম রহমতুল্লাহ এম. এ. বিটি সাহেবের মুখ থেকে আমি ছাত্রজীবনে এই কথা শুনেছি। তিনি আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন। আদর্শ শিক্ষক হিসেবে ব্রিটিশ সরকার তাকে খান বাহাদুর টাইটেল দিয়েছিল। সেই যুগে গোটা জেলায় তার মতো অমন বাঘা হেডমাস্টার একজনও ছিলেন না। তাকে কেউ কখনো একটিও বেহুদা কথা বলতে শোনেনি। জীবদ্দশায় তিনি তিন তিনবার পবিত্র মক্কা শরীফ জেয়ারত করেছিলেন। এন্তেকালের পর তার কবরটা একটি দরগাতে পরিণত হয়েছে। তার মুখ থেকে যে কথাটি অনেকবার শুনেছি আমি অকপটে বলেছি এতে দোষের কী থাকতে পারে।
এমন অকাট্য প্রমাণ হাজির করবার পর ড. (কবি) মনিরুল আলমের আর কিছু বলার রইল না। দুদিন না যেতেই বিরোধী দল সমর্থক সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রটিতে আবু জুনায়েদের একটি কার্টুন চিত্র প্রকাশিত হলো। আবু জুনায়েদের প্রতিকৃতি শূয়রের আকারে আঁকা হয়েছে, সামনে মাইক্রোফোন এবং তিনি কবিতা সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন।
উপাচার্য পদে আসীন হওয়ার পর থেকে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের একটি নতুন অভ্যেস জন্ম নিয়েছে। তিনি নিয়মিত শুক্রবারে মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজটি আদায় করতে শুরু করেছেন। তার মধ্যে কোনোরকম ধর্মপ্রীতি বা পরকালভীতি জন্ম নিয়েছে বলেই শুক্রবারে মসজিদে আসাআসি করছেন, সেটা সত্যি নয়। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লে তার প্রতি এক শ্রেণীর মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা বাড়ে, সেটা ঠিক । তবু আবু জুনায়েদ সঠিক বুঝে উঠতে পারেন না, কী কারণে তার এ নতুন অভ্যেসটি জন্মেছে।
মসজিদে কিছুদিন যাওয়া আসার পর আবু জুনায়েদের উপলব্ধি করতে বাকি রইল না, এর একটি সাংঘাতিক ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই মসজিদে এসেই তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হন স্বঘোষিত নাস্তিক আহমদ তকির উপর সাধারণ মুসল্লির কী পরিমাণ ঘৃণা রয়েছে। আহমদ তকি ভদ্রলোকটির সঙ্গে তার এক ধরনের খাতির হয়েছিল। তকি সাহেব রস করে কথাবার্তা বলতে জানতেন এবং আবু জুনায়েদ সেটা উপভোগও করতেন। আর তাছাড়া অনেক ভালো কথাও তকি সাহেব বলে থাকেন। মসজিদে এসেই আবু জুনায়েদ টের পেয়ে যান যে, আহমদ তকি এই সময়ের মধ্যে আল্লাহ এবং তার প্রিয় রসুলের খাস দুশমনে পরিণত হয়েছেন। সহজাত অনুভব দিয়েই আবু জুনায়েদ বুঝে গেলেন ভবিষ্যতে আহমদ তকির সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
আহমদ তকি আল্লাহ রসুলের পুরনো চিহ্নিত দুশমন। এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আল্লাহ রসুলের যে সকল নতুন দুশমন পয়দা হয়েছে, তাদের সকলের নাড়িনক্ষত্রের খবর জেনে গেছেন। আবু জুনায়েদ মনে করেন, একটা ব্যাপারে তিনি লাভবান হতে পেরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনমতের হাওয়া কোনদিকে বইছে মসজিদে এলে তার একটি পূর্বাভাস তিনি পেয়ে যান। হালে তার মধ্যে একটা নতুন অন্তদৃষ্টি জন্মাতে আরম্ভ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যাপারে জনমত গঠন করার জন্য মসজিদ একটি মোক্ষম জায়গা।
এক শুক্রবারে তার মসজিদে আসতে একটু দেরি হয়েছিল। তিনি পেছনের কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেছিলেন। কিন্তু নামাজ শেষ হওয়ায় অন্যান্য মুসুল্লীরা তাকে সামনে আসতে অনুরোধ করলেন। তিনি সামনে এলে চার পাঁচজন মুসল্লী একসঙ্গে কবিতা সম্মেলনে নজরুল ইসলাম সম্পর্কিত একেবারে বৈজ্ঞানিক সত্যটি (অর্থাৎ হিন্দুরা তার মাথাটি খারাপ করে দিয়েছিল) প্রকাশ করার জন্য একসঙ্গে ধন্যবাদ জানালেন। ফার্সি ভাষার শিক্ষক (যে বিষয়ে একজনও ছাত্র নেই) মাওলানা আবদুর রহমান তালিব দাঁড়িয়ে তার হস্ত চুম্বন করলেন এবং প্রকাশ্যে আলিঙ্গন দান করলেন। তারপর আবদুর রহমান তালিব সাহেব সমবেত মুসল্লিদের সামনে ঘোষণা দিয়ে বসলেন, এই এতদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন পরহেজগার উপাচার্য এসেছেন। আল্লাহ তার হায়াত দারাজ করুন। এই উপাচার্যকে দিয়ে ইসলামের অনেক খেদমত হবে। নামাজ শেষ করে বেরিয়ে আসছিলেন। মাওলানা আবদুর রহমান তালিব সাহেব অনুরোধ করলেন,