অবশেষে একদিন শিক্ষকেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ক্লাশে যোগ দিলেন। ঠিক সেই সময়ে দুই প্রধান ছাত্র সংগঠনের মধ্যে একটা সম্মুখ সমর বেঁধে গেল। মারা গেছে আটজন এবং আহত হয়েছে একশ জনেরও বেশি। যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর সকলেই নির্দলীয় ছাত্র। প্রাণ দেয়া প্রাণ নেয়ার নেশা দু দলের বীর পুরুষদের এমনভাবে পেয়ে বসল তিনদিন ধরে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কুরুক্ষেত্রের আকার ধারণ করল। কাটা রাইফেল ও মেশিনগান অবাধে ব্যবহার হতে লাগল। বোমাবাজির শব্দে কানপাতা দায় হয়ে দাঁড়ালো। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে সিন্ডিকেট ডেকে আবার অনির্দিষ্টকালের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হলো।
বিশ্ববিদ্যালয় যখন একেবারে বন্ধ হয়ে যায় তখন আবু জুনায়েদের খুব খালি খালি লাগে। নানা উত্তেজনার মধ্যে সময় কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। চাপের মধ্যে থাকার একটা মজা হলো, নিজেকে কিছুই করতে হয় না, ঘটনা ঘটনার জন্ম দিয়ে চলে এবং ঘটনাস্রোতই সবকিছুকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। এ রকম সময় এলে মনটা
কাঁচা বাজারে যাওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করতে থাকে। হায়রে সেদিন কি আর আছে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে কত কবি বাস করেন সঠিক সংখ্যাটি নিরূপণ করা হয়নি। দুশও হতে পারে আবার তিনশও হতে পারে। ফুল টাইম পার্ট টাইম মিলিয়ে যত লোক কবিতা লেখেন, প্রথম প্রেমে পড়ার উত্তাপ ছন্দোবদ্ধ অথবা গদ্য কবিতায় প্রকাশ করেন, সব মিলিয়ে হিসেব করলে হাজারখানেক দাঁড়িয়ে যেতে পারে। তিরিশ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র এক হাজার কবি, সংখ্যাটা কিছুতেই অধিক বলা যাবে না। বাঙালি মাত্রেই তো কবি। এমনকি বাংলার দোয়েল, শ্যামা, কোকিল ইত্যাকার বিহঙ্গকুলের মধ্যে কবিত্বের লক্ষণ অত্যধিক মাত্রায় পরিস্ফুট। বিহঙ্গ সমাজের মধ্যে প্রচলিত সাধারণ কোনো বর্ণমালার চল নেই বলেই ওদের কবিত্ব শক্তির প্রতি আমরা উদাসীন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে স্থায়ীভাবে যারা কবিতা রচনার কাজে নিবেদিত রয়েছেন তরুণে প্রবীণে মিলিয়ে তাদের সংখ্যা গোটাতিরিশেক দাঁড়াতে পারে। মোটে তিরিশ জন, ফুলটাইম কবি তাদের মধ্যে মত ও পথের এত ফারাক যে খুব সূক্ষ্মভাবে হিসেব করলে একত্রিশটি উপদলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করা অসম্ভব হবে না। কবিদের কেউ কেউ বলেন কবিতাকে হতে হবে সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার । আরেক দল বলেন কবিতায় বিপ্লব টিপ্লবের কথা বলা এক ধরনের অশ্লীলতা। কবিতাকে পরিশুদ্ধ কবিতা হতে হলে অবশ্যই প্রেম থাকতে হবে। আরেকটি উপদল মনে করে প্রেম আবার কী? প্রেম কাকে বলে? মেনি বিড়ালের সঙ্গিনী খোঁজার চিৎকার যাকে ভদ্র ভাষায় প্রেম বলা হয়, ওই জিনিস কি কবিতার বিষয়বস্তু হতে পারে? এই রকম কত আছে! কেউ বলে ছন্দ দিয়ে কবিতা লেখা হয়, কেউ বলে ভাবই কবিতার আসল প্রাণবস্তু। আরেক দল বুকে তাল ঠুকে প্রকাশ করতে কসুর করে না ভাষাই কবিতার সবকিছু। এই ধরনের যত প্রকারের মতভেদ আছে সেগুলোর কোনোদিন নিরসন হবে, কবিরাও তা আশা করেন না। ডিম্ব আগে না বাচ্চা আগে এই বিতর্ক চলতে থাকবে।
সূক্ষ্ম ভেদ, উপভেদ এগুলো আপনিই লুপ্ত হয়ে যায়, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী কবিগোষ্ঠী সুযোগ-সুবিধের প্রশ্নে একে অপরের প্রতিস্পর্ধী হয়ে দাঁড়ায়। একদল বাংলা একাডেমীর মাঠে কবিতা পড়লে, আরেক দল শিল্পকলা একাডেমীর মিলনায়তনে এসে জড়ো হন। যেহেতু রাজনীতি সমাজের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তাই কবিদেরও রাজনৈতিক ছাতার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। বিরোধী দলীয় কবিদের সুবিধে একটু বেশি। কারণ দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকারকে আক্রমণ করা সহজ এবং তা করে অনায়াসে পাঠক বাহবা লাভ করা যায়। বিরোধী দলের কবিরা যদি স্লোগান দেয় কবিতা মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা রুখতে পারে। সরকার ঘেঁষা কবিরা আরো মনকাড়া স্লোগান উচ্চারণ করেন, প্রকৃত কবিতা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকিয়ে দিতে পারে।
মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ কবিতার কিছুই বোঝেন না। তথাপি তাকে সরকার ঘেঁষা কবিদের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হওয়ার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাংলার প্রবীণ অধ্যাপক সরকারঘেঁষা কবিদের সংগঠনটির সভাপতি। তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে আবু জুনায়েদের দল করে থাকেন। ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদকসহ এসে ড. (কবি) মনিরুল আলম যখন ধরে বসলেন আবু জুনায়েদ না করতে পারলেন না। সভা-সমিতিতে কথা বলতে বলতে এককালীন মুখচোরা লাজুক মানুষ আবু জুনায়েদের জিহ্বাটি ওই সময়ের মধ্যে অসম্ভব রকমের ধারালো হয়ে উঠেছে। যে কোনো সভায় কোনোরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া ঝাড়া আড়াই ঘণ্টা বক্তৃতা দিতে পারেন। উপাচার্য হওয়ার প্রথম দিকে সভা-সমিতিতে কথা বলতে উঠলে তার হাত পা কাঁপত, গলা শুকিয়ে আসত। এখন কথা বলতে গেলে জিহ্বাটি আপনা থেকে নেচে উঠতে চায়। শব্দগুলো বাকযন্ত্রের মুখে পুঁটি মাছের মতো আপনিই উজিয়ে আসে । তথাপি কোনো জটিল বিষয়ে বক্তৃতা দেয়ার প্রশ্ন উঠলেই ব্যক্তিগত সহকারীকে ডেকে সে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর করতে নির্দেশ করতেন। মোটের উপর একটা প্রস্তুতি গ্রহণ করেই সভা-সমিতিতে যেতেন। এই কবিদের সভাটিতে যাওয়ার সময় সহকারীকে ডাকার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। আবু জুনায়েদ নিশ্চিতভাবে জানতেন বাংলা সাহিত্য বিষয়ে তার ব্যক্তিগত সহকারীর জানাশোনা তার চাইতে অনেক কম। সুতরাং, শুধু আত্মপ্রত্যয়ের উপর নির্ভর করে সরকারঘেঁষা কবি সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে একটা মজার বক্তৃতা দিয়ে বসলেন।