একজন ছাত্র ভাতের থালাটি ডাইনিং টেবিলে উপুড় করে দিয়ে স্লোগান দিয়ে উঠল, ‘ভাতের সঙ্গে কাকড় কেন আবু জুনায়েদ জবাব চাই’। যে সকল ছাত্র ভেতরে প্রবেশ না করে বাইরে ভিড় করেছিল তারাও সকলে মিলে স্লোগান দিতে থাকল ‘আবু জুনায়েদের চামড়া, তুলে নেব আমরা’। ছাত্রদের হাতে আবু জুনায়েদের লাঞ্ছনা এবং ভোগান্তি দেখে নুরুন্নাহার বানুর হাততালি দিয়ে খলখল করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করে। কোন্ বাপের মেয়েকে অপমান করেছে, আবু জুনায়েদ! আল্লাহ কি নেই?
একদিন মহিলা হোস্টেলের পাশের ট্রান্সফরমারটি বিকট একটা শব্দ করে জানিয়ে দিল যে বেটা আত্মহত্যা করেছে! এই অকালপ্রয়াত ট্রান্সফর্মার মহিলা হোস্টেলের ছাত্রীদের একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার মধ্যে ছুঁড়ে দিল। দুদিন ধরে হোস্টেলে কোনো পানি নেই। মেয়েদের গোসল, টয়লেট সব একরকম বন্ধ। বাইরে থেকে বালতি বালতি পানি আনিয়ে এক বেলার নাস্তা এবং রান্না কোনো রকমে সারা হয়েছে। মেয়েরা প্রথমে হাউজ টিউটর, তারপর প্রভোস্টের কাছে নালিশ করল। কোনো ফল হলো না দেখে সকলে তোয়ালে কাঁধে জড়িয়ে সাত পাঁচশ মেয়ে একযোগে উপাচার্যের বাড়ি ঘেরাও করে বসল। প্রমিলাবাহিনীকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা দারোয়ানের কী করে হবে। তাদের একদল উপাচার্য ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে বাথরুমের বেসিন কমোড এগুলো ভাঙচুর করতে থাকল। আবু জুনায়েদের কিছুই করার ছিল না। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রলয়কাণ্ড দেখলেন। নুরুন্নাহার বানু ফস করে একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন । এই মন্তব্য শুনে একটি মোটা উঁচু ষণ্ডামার্কা মেয়ে তার পরনের শাড়ির অর্ধেক টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই মেয়েরা যেমন পঙ্গপালের মতো ঝাঁক বেঁধে এসেছিল, তেমনি ঝাঁক বেঁধে চলে গেল। চলে যাবার সময়ে একটি বব কাটিং চুলের মেয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রিভলবার বের করে আবু জুনায়েদের মস্তক তাক করে উঁচিয়ে ধরে বলল
-চাঁদু যেন মনে থাকে, কত ধানে কত চাল। গাঁইগুই করলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব ।
হোস্টেলের মেয়েরা সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পর নুরুন্নাহার বানু সিঁড়ির উপর বসে সমস্ত জীবন ধরে যে সমস্ত গালাগাল মুখস্থ করে রেখেছিলেন, একে একে মেয়েদের উদ্দেশ্যে ঝাড়তে লাগলেন-খানকি, মাগি, বেশ্যা, ছেনাল-হায়েজ নেফাজের পয়দায়েস আরো কত কী। মনে মনে সন্ধান করতে লাগলেন আরো শক্তিশালী গালাগাল আছে কি না। সে রকম কোনো কিছু না পেয়ে আবু জুনায়েদকে নিয়ে লাগলেন। তার দিকে রোষ কষায়িত লোচনে তাকিয়ে বলতে লাগলেন
-তোমার মতো একটা ছাগলের সঙ্গ বিয়ে হয়েছিল বলে এই ছেনাল মাগীদের হাতে আমাকে নাকাল হতে হলো।
সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় নতত্ত্ব বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে জোর লেখালেখি চলছে । ভদ্রলোক ছাত্রছাত্রীদের কাছে টাকা নিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রয়ের ব্যবসাটি নিরাপদে এতদিন চালিয়ে আসছিলেন। অল্প কদিন আগে সেটি ধরা পড়েছে। বিভাগের সমস্ত শিক্ষক এবং ছাত্রেরা অকাট্য প্রমাণসহ উপাচার্যের কাছে দাবি জানিয়েছেন, এই ভদ্রলোক যদি এই বিভাগে বহাল থাকেন শিক্ষকেরা ক্লাশ নেবেন না এবং ছাত্রেরাও শিক্ষকদের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদও মনে মনে স্বীকার করেন, আবদুর রহমানের চাকরিটি থাকা উচিত নয় । কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার হলো আবদুর হলেন উপাচার্যের নিজের দলের লোক। দলের কেউ চাইবেন না, আবদুর রহমানের চাকরিটি চলে যাক। আবু জুনায়েদের ইচ্ছে আবদুর রহমানকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু উপাচার্যের ইচ্ছেই তো সব না, সিনেট আছে, সিন্ডিকেট আছে। সেখানে ব্যাপারটা ফয়সালা করতে হবে। সিনেট সিন্ডিকেটে আবদুর রহমান দলে ভারি। সুতরাং, আবদুর রহমানের অপরাধ কবুল করেও তিনি তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা রাখেন না। আবদুর রহমানকে বরখাস্ত করলে তার দলটি কানা হয়ে যাবে। দল না থাকলে আবু জুনায়েদকেও কানা হয়ে যেতে হবে ।
সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের ছেলেমেয়েরা সদলবলে মিছিল করে এসে উপাচার্যের দপ্তরের দরজা জানালা ভাঙচুর করেছে। তাদের দাবি ছিল একটিই কেন তাদের পরীক্ষার তারিখ বারবার পিছানো হচ্ছে। ভাঙা দরজা জানালা নতুন করে মেরামত করার পর সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা তাদের পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে মেরামত করা দরজা জানালা আবার নতুন করে ভেঙে দিয়ে গেছে।
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তাদের বেতন এবং ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে একটানা সাত দিন কর্মবিরতি পালন করেছেন । তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সপ্তাহব্যাপী কর্ম বিরতির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসারেরা পাঁচ দিনের কর্ম বিরতির ঘোষণা করেছেন। তাদেরও বেতন ভাতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অফিসারদের কর্মবিরতির পর শিক্ষকেরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডেকে বসলেন। তাদের দাবি বেতন-ভাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অনেক দূর প্রসারিত । বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সের সমস্ত দাবি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসরদের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর করতে হবে এবং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরদের প্রফেসর । মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদও স্বীকার করেন এগুলো শিক্ষকদের অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবি। কিন্তু দুঃখের কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে কোনো বাড়তি টাকা নেই। বাজেটের বরাদ্দ সমস্ত অর্থ ব্যয় করা হয়ে গেছে। শিক্ষকেরা আড়াই মাস গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ালেন। আর তাদের মধ্যে যারা সত্যিকার করিতকর্মা চুটিয়ে কনসালটেন্সি ব্যবসা চালালেন।