তুমি কি মনে করো স্যুট বুট পরলে তোমাকে সুন্দর দেখায়? তোমার হনুমানের মতো চেহারার কোনো খোলতাই হয়?
কথাটি শুনে আবু জুনায়েদ ভীষণ রেগে গেলেন । জবাবে বললেন—
আমাকে কেমন দেখায় তা নিয়ে তোমার মাথা ব্যথা কেন?
নুরুন্নাহার বানু আবু জুনায়েদের মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন :
–আমার কেন মাথা ব্যথা হবে? মাথা ব্যথা হবে ওই খানকি দিলরুবা খানমের? আমার আব্বা যদি তোমার পেছনে গাঁটের টাকা না ঢালতেন, আজকে তুমি কোথায় থাকতে?
মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করার লোকের অভাব নেই। সম্প্রতি তিনি বিশ্বস্তসূত্রে সংবাদ পেয়েছেন শিক্ষক সমিতির সভায় একজন প্রবীণ শিক্ষক রসিকতা করে তাকে ওরাং ওটাঙের সঙ্গে তুলনা করেছেন। দিলরুবা খানম তাকে হরদম দরজির দোকানের ডামি বলে সকলের কাছে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন । বুড়ো বুড়ো শিক্ষকেরা তার নামে এটা কেন বলে বেড়ান, বিলকুল তিনি বুঝতে পারেন। তার মতো শিক্ষক সমাজের একজন অপাঙক্তেয় মানুষ ভাগ্যের কৃপায় তাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে উপাচার্যের আসন দখল করে বসলেন, তাদের দৃষ্টিতে এটা অপরাধ। এই কারণেই তাদের সকলের নখ দাঁত গজিয়েছে। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ যতই বোকা হয়ে থাকুন না ওই ব্যাপারটা বোঝার মতো বুদ্ধি তার আছে। কিন্তু দিলরুবা খানম কেন সর্বক্ষণ তার নামে নিন্দের গীত গেয়ে বেড়াচ্ছেন, তিনি তার কোনো কারণ খুঁজে পান না। বলতে গেলে দিলরুবা খানমই তো তাকে হাত ধরে উপাচার্যের আসনটিতে বসিয়ে দিয়ে গেছেন।
মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ ভাবতে চেষ্টা করেন, এর হেতুটা কী হতে পারে? নারীর মনের গহন রহস্য আবু জুনায়েদের মতো ভোঁতা মানুষের বোঝার কথা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে নুরুন্নাহার বানুর পৌনঃপুনিক খোঁচা খেয়ে একটা বিষয় তার মনে আনাগোনা করে। দিলরুবা খানম কি তার প্রেমে পড়েছিলেন? প্রেমে না পড়লে, বলতে গেলে একা একটি জেহাদ পরিচালনা করে তাকে উপাচার্যের চেয়ারে বসালেন কেন? যতই বিষয়টা গভীরভাবে চিন্তা করেন, তিনি একটা ধাঁধায় পড়ে যান। দিলরুবা খানম তাকে এই যে এতদূর টেনে নিয়ে এলেন, তার পেছনে বিশুদ্ধ অনুরাগ ছাড়া আর কী স্বার্থ থাকতে পারে? মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ ভাবতে চেষ্টা করেন কোনো কারণে দিলরুবা খানমের কোনো দুর্বল জায়গায় তিনি আঘাত করে বসেছেন। তাই তিনি সকাল বিকেল তার বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই বলে বেড়াচ্ছেন। মানুষের মনের ভেতর কত রকম অলিগলি থাকতে পারে চিন্তা করে আবু জুনায়েদ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান । নুরুন্নাহার বানু যদি ক্রমাগতভাবে দিলরুবা খানমের নাম করে তাকে খোঁচা না দিতেন এদিকটা চিন্তা করে দেখার ফুরসতও তার হতো না।
আবু জুনায়েদ টাইয়ের নট বাঁধা শেষ করেন। জুতো পরতে গিয়ে দেখা গেল মোজা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করলেন, পাওয়া গেল না। ছোকরা চাকরটিকে ডেকে আচ্ছা করে ধমকে দিলেন । নুরুন্নাহার বানুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখো না মোজাজোড়া কোথায়? এদিকে আমার মিটিং শুরু হয়ে গেছে। নুরুন্নাহার বানু আঙুলে শাড়ির কোণা জড়াতে জড়াতে বললেন,
-তুমি আমার বাবার চাকর । তোমার আমার কাজ করে দেয়ার কথা, আমি কেন তোমার কাজ করব?
-কী বললে, আবু জুনায়েদ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন।
-তোমার বাবার কাছে চলে যাও। যে টাকার খোটা প্রতিদিন দিয়ে যাচ্ছ আমি সুদে আসলে শোধ করে দেব। তারপর মোজা না পরেই আবু জুনায়েদ জুতোয় খালি পা গলিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন।
আবু জুনায়েদ চলে যাওয়ার পর নুরুন্নাহার বানু জগটা টেনে নিয়ে সবটা পানি ঢকঢক করে পান করে ফেললেন। মিনমিনে স্বভাবের আবু জুনায়েদ কখনো ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানতেন না। সেই মানুষটি কত প্রচণ্ড হতে পারেন তার প্রমাণ নুরুন্নাহার বানু হাতেনাতে পেয়ে গেলেন। তার সারা শরীর জ্বালা করছিল। তিনি চিৎকার করে উঠতে চাইলেন। পারলেন না, কে যেন কণ্ঠস্বর চেপে ধরল। পরম বেদনায় তিনি অনুভব করলেন, তার প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়ে আসছে। উপাচার্যের চাকরি, এই সুদৃশ্য অট্টালিকা, গণ্ডায় গণ্ডায় লোকজন সাজসজ্জা সবকিছুকে তার অভিশাপ দিতে ইচ্ছে হলো ।
উপাচার্যের চাকরি করতে গিয়ে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ প্রতিদিন টের পাচ্ছিলেন তার ভেতরে অবিরাম ভাঙচুর চলছে। আগামী দিনে কী ঘটবে সে কথা বাদ দিন, একঘণ্টা পরে কী ঘটবে, সেটাও অনুমান করার উপায় নেই। আবু জুনায়েদ উপাচার্য হওয়ার পরে অর্থনীতি বিভাগের একজন ছাত্র খুন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দুটি ছাত্রদলই দাবি করেছে নিহত ছাত্রটি তাদের দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। দুদলই উপাচার্য ভবনের সামনে এসে মিছিল করেছে, স্লোগান দিয়েছে। দুদলই উচ্চ চিৎকারে দাবি করেছে জহিরুল হক কেন খুন হলো, সে জবাব আবু জুনায়েদকেই দিতে হবে। দুদলই চরম উত্তেজনার সঙ্গে জহিরুল হকের খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। নিহত ছাত্রের লাশটিও কারা দখল করবে তাই নিয়ে দুদলের মধ্যে যে তোড়জোড় চলছিল, অনায়াসে আরো এক ডজন ছাত্র খুন হতে পারত। সময়মতো পুলিশ এসে হস্তক্ষেপ করেছিল, তাই রক্ষে । নিহত ছাত্রটির গ্রামের বাড়ি কাঁপাসিয়া । সংবাদ পেয়ে মা-বাবা দুজনেই ছুটে এসেছিলেন । গ্রামের কৃষক । আবু জুনায়েদকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুত্র শোকাতুর মা-বাবার বুকফাটা ক্রন্দন শুনতে হয়েছে। একেবারে দাঁড়িয়ে থেকে ছাত্রটির লাশ বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। অনবধানতাবশত কোনো একদল যদি লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যেত তাহলে সেই লাশ কাঁধে নিয়ে শহরে মিছিল করার সুযোগ পেলে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা অসম্ভব ছিল না যার ফলে গোটা দেশে খুন এবং পাল্টা খুনের একটা উৎসব লেগে যেত। ব্যাপারটি যদি এতটুকুতে চুকেবুকে যেত তাহলেও কথা ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং ডেকে নিয়ে ধমক দিয়েছেন, সরকারি ছাত্রদলটির সমর্থক শহীদ ছাত্রটির খুনীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তিনি কেন তাদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিচ্ছেন না। আবার বিরোধী দলের একজন নেতা টেলিফোন করে শাসিয়ে দিয়েছেন, তাদের সমর্থক সুবোধ ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপদে লেখাপড়া করতে পারছে না। সরকার তাদের অযথা হয়রানি করার জন্য পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে এবং আবু জুনায়েদ সরকারকে সাহায্য করে যাচ্ছেন, একথাটি যেন মনে থাকে। সব সময় দিন একরকম থাকবে না। কেন্টিনে চালের সঙ্গে বেশি কাকড় পাওয়া গেছে। ছাত্রেরা ভাতের থালাসহ দল বেঁধে মিছিল করে উপাচার্য ভবনে প্রবেশ করে একেবারে ডাইনিং রুমে চলে এসেছে। তখন আবু জুনায়েদ, নুরুন্নাহার বানু এবং একজন মেহমান দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন। দারোয়ান কেয়ারটেকার কারো বাধা ছাত্রদের ঠেকাতে পারেনি ।