-সকালে নাস্তা পানি মুখে না দিয়ে অমন হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটে গিয়েছিলে?
-আবু জুনায়েদ খুব খুশি হয়ে উঠলেন, তাহলে মেঘ কেটে গেছে। তিনি মনে মনে খুব স্বস্তি বোধ করলেন। এ বেলাটা মনে হচ্ছে ভালোই কাটবে।
-এখনো কি তোমাকে আবার বেরুতে হবে? জিজ্ঞেস করলেন নুরুন্নাহার বানু।
-না এ বেলা আর কোনো প্রোগ্রাম নেই, ঘরে থাকব । ভাবছি চা খাওয়ার পর বাড়ির পেছনের দিকটা একবার দেখব ।
নুরুন্নাহার বানুর মনে পড়ে গেল সকালবেলা সালামত মিয়া বলেছেন, পেছনে অনেক জমি আছে, সেখানে তার তরকারির বাগান করে দেয়ার কথা বলেছেন। প্রস্তাবটা তার খুব পছন্দ হয়ে গেল।
-আগে চাটা খেয়ে নিই। তারপর দুজন এক সঙ্গে যাব ।
নুরুন্নাহার বানু এবং জুনায়েদ যখন বাড়ির পেছনে এলেন, তখন বিকেলের রোদের তেজটা মরে এসেছে। এই বাড়ির পেছনে ঝোপেঝাড়ে ঢাকা এমন আশ্চর্য সুন্দর এক নির্জন পরিবেশ আছে, এখানে আসার আগে দুজনের কেউ চিন্তা করতে পারেননি। তারা কাঠবিড়ালিদের ছুটোছুটি করতে দেখলেন। দূরে কোথায় ঘুঘুর ডাক শুনতে পেলেন। সবুজ সতেজ দুর্বাবেষ্টিত প্রসারিত ভূমির উপর হাঁটতে হাঁটতে আবু জুনায়েদের মনে এল, এখন তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তার হাতে অনেক ক্ষমতা। শিশু যেমন প্রথম মাতৃ স্তন মুখে লাগিয়ে দুধের স্বাদ অনুভব করে, তেমনি আজ সকাল থেকে তিনি ক্ষমতার স্বাদ অনুভব করতে আরম্ভ করেছেন। এই ক্ষমতা নিয়ে কী করবেন চিন্তা করতে লাগলেন। এই ক্ষমতা নিয়ে কী করবেন? এই অপার ক্ষমতা দিয়ে যদি তার কোনো একটা শখ পূরণ করতে পারতেন, তাহলে সবচাইতে খুশি হয়ে উঠতে পারতেন। সহসা তার মনে এল, তিনি একটা দুধেল গাই পুষবেন। অঢেল জায়গা, প্রচুর ঘাস। অনায়াসে একটা গাই পোঝা যায় । গাইয়ের কথা মনে হওয়ার পর তার বাপের চেহারাটা চোখের সামনে জেগে উঠল । তার বাবা প্রতিদিন ধলেশ্বরির পাড়ে পাড়ে দড়ি ধরে গাই গরুটা চরাতে নিয়ে যেতেন। একদিন পাড় ভেঙে বাবা এবং গাই উভয়েই পানিতে পড়ে গিয়েছিলেন। আয়ু ছিল তাই বেঁচে গিয়েছিলেন। এই গাইয়ের এক গ্লাস টাটকা গরম ফেনা ওঠা দুধ প্রতিদিন বিকেল বেলা তাকে পান করতে হতো। বাবা মরেছেন কতদিন হয়ে গেল। তবু মনে হয় গত কালের ঘটনা। আবু জুনায়েদ বারবার পরীক্ষায় ভালো করতেন। পরীক্ষায় ভালো করার পেছনের কারণ আবু জুনায়েদের প্রকৃতিদত্ত মেধা নাকি গাইয়ের দুধের উপকার, দুটোর মধ্যে কোনটা সত্যি এখনো স্থির করতে পারেন নি। দুধের ব্যাপারে তিনি ভাবনা-চিন্তা করছিলেন, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই গয়লাদের কথা তার মনে এল। এদের স্বভাব-চরিত্র ভীষণ খারাপ। দুধের মধ্যে শহরের ড্রেনের পানি মিশেল দিতেও তাদের আটকায় না। সমস্ত গয়লা শ্রেণীর উপর তার ভয়ানক রাগ। উপাচার্যের বদলে গয়লাদের শায়েস্তা করার কোনো চাকরি যদি পেতেন তার ধারণা তিনি আরো সুখী হতেন। মানুষের এই শত্রুদের তিনি থামের সঙ্গে বেঁধে আচ্ছা করে চাবকাবার হুকুম দিতেন। তিনি হাঁটছিলেন, আর অস্ফুটে কী সব বলছিলেন । নুরুন্নাহার বানুর মনে হলো, তার স্বামীটি তারই চোখের সামনে ভিন্ন প্রাণীতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। তার রূপান্তর, পরিবর্তনের সবগুলো চিহ্ন তার চোখে এখন স্পষ্টভাবে ধরা পড়তে আরম্ভ করেছে।
আবু জুনায়েদ ডালপালা প্রসারিত ছাতিম গাছটিতে পিঠ ঠেকিয়ে স্বগতোক্তি করার মতো বলে ফেললেন: আমি একটা গাই গরু কিনব। এখন রাখার জায়গার অভাব নেই এবং ঘাসও বিস্তর। একটা গরু পোষার শখ অনেক দিনের। এবার আল্লাহ আশা পূরণ করার সুযোগ দিয়েছেন।
নুরুন্নাহার শুনে লাফিয়ে উঠলেন:
–সত্যি তুমি গাই কিনবে?
হ্যাঁ। আবু জুনায়েদ জবাব দিলেন ।
খুশিতে নুরুন্নাহার আবু জুনায়েদকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন । আবু জুনায়েদ তার মুখ চুম্বন করলেন।
.
০৫.
মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ থ্রি পিস স্যুট পরতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন। দিলরুবা খানম যতই তাকে দরজির দোকানের ডামি বলে লোকসমাজে অপদস্থ করতে চেষ্টা করুন না কেন, স্যুট টাই পরলে কোত্থেকে একটা আলগা বুকের বল তিনি অনুভব করেন। স্যুট পরে তিনি অফিস করেন, স্যুট পরে লোকজনের সঙ্গে দেখা করেন। যেদিন স্যুট গায়ে থাকে না, সেদিন নিজেকে ভারি বেচারা বেচারা বোধ করতে থাকেন। আবু জুনায়েদ মনে করতে থাকেন তিনি উলঙ্গ রয়েছেন। আর সব মানুষ তার যাবতীয় অক্ষমতা, দুর্বলতা এমনকি পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত দেখে ফেলছে। বাড়িতেও সর্বক্ষণ স্যুট পরে থাকতে চেষ্টা করেন। এই পোশাকটা তার শরীরে নতুন জন্মানো চামড়ার মতো সাপটে থাকে। মোট কথা, এই কয়দিনে তার এতদূর রূপান্তর ঘটেছে, মাঝে-মাঝে তিনি ভাবতে চেষ্টা করেন, এই স্যুট এই টাইসহ তিনি মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন কি না। যেদিন থেকে তিনি উপাচার্যের আসনটিতে বসেছেন, বুঝে গেছেন এই পোশাকটাই তার একমাত্র ভরসা। এই পোশাকই তাকে সোলেমানী গালিচার মতো বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করবে। এই গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনও তার বন্ধু নেই, সেই নিষ্ঠুর তেতো সত্যটি তিনি দাঁত তোলার মতো বেদনা দিয়ে অনুভব করেছেন।
বেগম নুরুন্নাহার বানু তার স্বামীর বেশভূষা দেখে হাসি-ঠাট্টা করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু মজার কথা হলো নির্মল হাসি-ঠাট্টা নুরুন্নাহার বানুর মুখ থেকে বেরোয় না। তিনি জখম না করে কাউকে কিছু বলতে পারেন না। একবার আবু জুনায়েদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টাইয়ের গেরোটি ঠিক করছিলেন, দেখে নুরুন্নাহার বানু মন্তব্য করে বসলেন