তরিতরকারি, মাছ, মাংসের দোকানে গেলে আবু জুনায়েদ নতুন মূর্তি ধারণ করতেন। ডিপার্টমেন্টে, বাড়িতে, বিশ্ববিদ্যালয় পাড়া সর্বত্র আবু জুনায়েদ মিনমিনে স্বভাবের লোক বলে পরিচিত ছিলেন। কাঁচা বাজারে পদার্পণ করামাত্রই কোত্থেকে একটা পৌরুষ এসে তার অস্তিত্বে ভর করত। লাল চোখ পাকিয়ে তরকারিঅলাকে ধমক দিতে একটুও ইতস্তত করতেন না। বলে বসতেন, মিয়া তোমার সাহস তো কম নয়, এই পচা পটলের কেজি চৌদ্দ টাকা দাবি করছ? তোমার জেল হওয়া উচিত। মাছঅলাকে বলে বসতে কসুর করতেন না, দেশে যদি আইন থাকত তোমার মতো মানুষকে বহু আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেত। কাঁটা পর্যন্ত পচে ভর্তা হয়ে গেছে, এমন মাছের চারগুণ দাম বেশি দাবি করছ। কশাইরা তো কশাই, ওদের সঙ্গে রাগারাগি করলে রাগের কোনো মূল্যই থাকে না, তাই আবু জুনায়েদ তাদের সম্পর্কে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতেন। তিনি মাংস বিক্রেতাদের ধারেকাছে যেতেন না, কারণ নুরুন্নাহার বানু মনে করতেন, আবু জুনায়েদের তাজা মাংস চিনে নেয়ার ক্ষমতা নেই। আবু জুনায়েদ রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক। রসায়নবিষয়ক গবেষণাটা তিনি কাঁচা বাজারেই চালাতেন। কাঁচা বাজারের প্রায় সমস্ত দোকানদার নিত্যদিনের ওই মহামান্য খদ্দেরটাকে চিনে নিয়েছিল। এই ভদ্রলোকের হাঁক-ডাক দরাদরির বহর এত প্রকাণ্ড ছিল যে যদি সম্ভব হতো সকলে মিলে এই আবু জুনায়েদের বাজারে প্রবেশ বন্ধ করে দিত। দোকানদারদের সে রকম কোনো আইন পাস করার ক্ষমতা থাকলে আবু জুনায়েদের বাজারে যাওয়া লাটে উঠত। পাক্কা তিনটি ঘণ্টা কাটিয়ে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে তিনি বাড়িতে ফিরতেন। আসার সময় তিনি রিকশা চাপতেন। বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে রেখে বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কোত-কোত শব্দ করে সারা শরীর থেকে কাঁচা বাজারের স্পর্শদোষ মুছে ফেলতে চেষ্টা করতেন।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে তিনি বাড়িতে কাঁচা পাজামা পাঞ্জাবী পরে একটু ফুরফুরে হয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন। টেলিভিশন খুলে বাংলা সংবাদটি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সংবাদের পরে যখন নতুন কোনো প্রোগ্রামের দিকে দৃষ্টি যোগ করতে চেষ্টা করতেন, সেই সময়ে নুরুন্নাহার বানু কিল চড় দিতে দিতে কলেজ পড়ুয়া মেয়েটিকে খাতা বইসহ আবু জুনায়েদের সামনে বসিয়ে দিতেন। অগত্যা আবু জুনায়েদকে মেয়েটিকে ক্যালকুলাস এবং ইংরেজি ব্যাকরণের ট্যান্স, নাম্বার, জেন্ডার এসব শেখাতে হতো। রাতের খাবার খেতে কোনোদিন দশটা বেজে যেত। খাওয়ার পর তিনি চুক চুক করে এক গ্লাস দুধ পান করতেন। তারপর বাতি নিভিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়তেন। এই সময়ে নুরুন্নাহার বানু বাসি পাউরুটির মতো থলথলে শরীরখানা মেলে ধরে তাকে উস্কে তোলার চেষ্টা করতেন। সব দিন তিনি সাড়া দিতে পারতেন না এবং পাশ ফিরে ঘুমোতেন। নুরুন্নাহার বানু মনে করতেন সেই ডিপার্টমেন্টের ছেনাল শিক্ষিকার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ইদানীং আবু জুনায়েদ শয্যায় তাকে উপেক্ষা করতে আরম্ভ করেছেন। আবু জুনায়েদ ঘুমিয়েই নাক ডাকতে শুরু করতেন। নুরুন্নাহার বানু ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে থাকতেন। আবু জুনায়েদের ঘুমটা গাঢ় হয়ে এলে ঠেলা দিয়ে তাকে জাগিয়ে দিয়ে গণ্ডারের মতো নাসিকা গর্জনের জন্য আধারাতে ঝগড়া লাগিয়ে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করতেন। আবু জুনায়েদের শরীর লম্বা লম্বা কালো কালো লোমে ভর্তি ছিল। একবার তো ম্যাচকাঠি জ্বালিয়ে লোমের বনে আগুনই ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের এ সকল অসঙ্গতি এগুলো কাল্পনিক হোক বা বাস্তব হোক বেগম নুরুন্নাহার বানু এবং কাঁচা বাজারের দোকানদারেরা ছাড়া অন্য কারো দৃষ্টিতে বিশেষ ধরা পড়েনি। তবে তার বৃদ্ধ শ্বশুর তার বিষয়ে মনের ভেতর একটা চাপা ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন। তার পয়সায় আবু জুনায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। তিনি মনে করেন বিগত কয়েক বছর ধরে আবু জুনায়েদ যেভাবে কদমবুসি করেন, তাতে ভক্তি শ্রদ্ধার পরিমাণ যথেষ্টভাবে কমে এসেছে। কিন্তু একথা তিনি মুখ ফুটে কারো কাছে প্রকাশ করেননি। আবু জুনায়েদের দৈনন্দিন জীবনযাপন পদ্ধতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে আমরা তার মধ্যে সামান্য পরিমাণ দোষও আবিষ্কার করতে পারিনি। নুরুন্নাহার বানুর মৌন সন্দেহটুকুকে ধর্তব্যের মধ্যে আনাও উচিত নয় মনে করি। তার সবটাই কাল্পনিক। মেয়ে মানুষ ঘরে বসে থাকলে এবং নিজেকে ক্লান্ত করার প্রচুর কাজ না থাকলে, মাথার উকুনের মতো মনের মধ্যে সন্দেহের উকুন বাসা বাঁধতে থাকে। তরকারিঅলা, মাছঅলা এদের মতামতের কী দাম। তারা তো অহরহ নিরীহ নাগরিকদের পকেট কাটছে।
এই পর্যায়ে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের একটি বিশেষ প্রবণতার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। এটাকে দোষ বলব বা গুণ বলব এখনো স্থির করে উঠতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিছাটার সময় আবু জুনায়েদ সাভার, আমিন বাজার, জয়দেবপুর, মাওয়া শহরতলী এসকল অঞ্চলে জমির দালালদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন। অল্প পয়সায় অধিক জমি কোথায় পাওয়া যায় এবং কীভাবে কেনা যায় সে ধান্ধায় মত্ত হয়ে থাকতেন। জমি কেনার আকাঙ্ক্ষা তার মনে মগজে নেশার মতো প্রবেশ করেছিল। তার দৈনন্দিন জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে ওই একটি বিষয় যেখানে তিনি কোনো শাসন বারণ মানতেন না। আবু জুনায়েদের মনে একটা পেশাগত অহংকার ছিল। সেটা চাপা থাকত। তবু তার যে সমস্ত সহকর্মী নানা প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক জরিপকারকের কাজ করে টাকা-পয়সা করে লাল হয়ে যাচ্ছেন, আবু জুনায়েদ তাদের সম্পর্কে নীচু ধারণা পোষণ করতেন। মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলার অভ্যাস নেই বলে এ-কথাটিও কাউকে বলা হয়নি। তার স্বভাবের মধ্যে পেশাগত অহংকারের সঙ্গে যোগ হয়েছিল একটা জেদ। আবু জুনায়েদ মনে করতেন, তার সহকর্মীরা অনৈতিক উপায়ের আশ্রয় গ্রহণ করে যে টাকা-পয়সা আয় করেন, তিনি সৎ ভাবে চেষ্টা করে অনেক বেশি টাকার মালিক হতে পারবেন। তিনি মনে করতেন, ওই জমিকে আশ্রয় করে একদিন তার ভাগ্য খুলে যাবে। নিশ্চয়ই কোথাও নামমাত্র মূল্যে তার জন্য প্রচুর পরিমাণ জমি অপেক্ষায় আছে। তার কাজ হলো খুঁজে বের করা। খুনোখুনি কিংবা অন্যরকম গণ্ডগোলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে আবু জুনায়েদ ভীষণ খুশি হয়ে উঠতেন। দালালদের নিয়ে তিনি দূর দূর অঞ্চলে জমির সন্ধানে পাড়ি জমাতেন। তার বাড়িতে নানা আকার নানা প্রকারের দালাল হরহামেশা লেগেই থাকত। তাদের কারো কারো পায়ে রবারের পাম্প সু, মুখে গুছি দাড়ি। কেউ ছাতাটি বগলে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে ড্রয়িং রুমে হানা দিত। আবু জুনায়েদ এ ধরনের লোকদের ভারি সমাদর করতেন। পরীক্ষার প্রশ্ন করে, খাতা দেখে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে গিয়ে মাস মাইনের বাইরে যে টাকা তিনি আয় করতেন, প্রায় তার সবটাই দালালদের সেবায় ব্যয় করতেন। পারলে মাস মাইনের টাকাটাও দালালদের পেছনে ঢেলে দিতেন। সেটি সম্ভব হয়নি। কারণ, সব টাকাটা নুরুন্নাহার বানুর হাতে তুলে দিতে হতো। দৈনন্দিন হাতখরচ টাকাটাও তাকে স্ত্রীর কাছ থেকে চেয়ে নিতে হতো। দশটা টাকা বেশি দাবি করলে দশ রকম জেরার সম্মুখীন হতে হতো।