বরঞ্চ তিনি তাদের কাছে নিজের কর্তৃত্বটা জাহির করা অধিক উপযুক্ত মনে করলেন। কে কী কাজ করে জিজ্ঞেস করলেন। ঝাড়দার ঝাড়দারনী বলল, মেম সাহেব আমরা বাগানে ঝাড় দিতে এসেছি। বাড়িতে যারা ঝাড়ামোছার কাজ করবে, আসবে বেলা আটটার সময়। সকালবেলা ওই সমস্ত ঝাড়দার ঝাড়ুদারনীর সঙ্গে কথা বলতে তার মন চাইছিল না। তিনি মনে মনে ভেবে নিলেন, ঘুম থেকে উঠে, এই শ্রেণীর মানুষদের সঙ্গে দেখা হলো, আজকের দিনটাই জানি কেমন যায়। মাথায় টুপি দাড়িঅলা বুড়ো মানুষটার দিকে তাকিয়ে মনে করলেন, হ্যাঁ, এই লোকের সঙ্গে তবু কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলা যেতে পারে । নুরুন্নাহার বানু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাজ কী?
বুড়ো ভদ্রলোকের মুখে একটা ছায়া পড়ল । সেদিকে নুরুন্নাহার বানুর চোখ আদৌ গেল না।
সালামত মিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন থেকেই মালীর কাজ করে আসছেন। তার পেশার জন্য নয়, প্রাচীনতা এবং প্রবীণত্বের জন্য সকলেই তাকে সমীহ করেন, এবং আপনি সম্বোধন করেন। নুরুন্নাহার বানুর মুখে তুমি শব্দটা তার মনে আঘাতের মতো বাজল। তিনি তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ক্ষুণ্ণ না করে প্রশান্ত স্বরে জবাব দিলেন :
আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড মালি। বিগত বিশ বছর ধরে আমি এই কাজ করে আসছি। হাতের খুন্তিখানা আদর করতে করতে বললেন, ওই জোয়ান ছাওয়ালটা দেখছেন সে আমার অ্যাসিস্টেন্ট এবং মেয়ের জামাইও । গত পাঁচ বছর ধরে আমার সঙ্গে কাজ করে। বর্তমান উপাচার্যের আগের জনের আগের জন দয়া করে জামাইকে চাকরিটা দিয়েছিলেন। নুরুন্নাহার বানুর মনে হঠাৎ করে হুকুম করার আকাক্ষাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তিনি বললেন :
চলো দেখাও দেখি তোমরা কী কাজ করো। সালামত মিয়া বললেন, বেগম সাহেবা আমার সঙ্গে সঙ্গে আসেন। বিরাট প্রশস্ত বাগান। সালামত মিয়া তাকে সাত রকমের গোলাপের গাছ দেখালেন। ক্রিসেনথেমামের ঝাড়গুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলো অল্প কদিন পরে ফুটবে। শীতকালীন ফুলগুলো যখন ফুটতে থাকবে দেখবেন বাগানের চেহারাই পাল্টে যাবে । সালামত মিয়া তার জামাইকে সদ্য ফোঁটা ফুল নিয়ে ঝটপট একটা তোড়া করতে বললেন। তোড়াটা নুরুন্নাহার বানুর হাতে দিয়ে বললেন, বেগম সাহেবা নিন। নুরুন্নাহার বানু তোড়াটা নিলেন, কিন্তু বিশেষ খুশি হতে পারলেন না। সেটা তার ভাব ভঙ্গিতে প্রকাশ পেল।
তোমরা এতগুলো মানুষ সব বেহুদা পাতাপুতা লতা এসব লাগিয়ে গোটা জমিটাই ভরিয়ে রেখেছ। ওগুলো কোন কাজে আসবে? সব কেটে ফেলবে। এপাশে লাগাবে ঢেঁড়শ, ওপাশে বরবটি আর ওই যে খালি জায়গাটা রয়েছে ওখানে লাগাবে বেগুন এবং সুরমাই মরিচের চারা। বাজারে চারা পাওয়া না গেলে বলবে, আমার বড় বোনের বাড়িতে অনেক আছে, এনে দেব।
নুরুন্নাহার বানুর কথা শুনে সালামত মিয়া একেবারে চুপ করে গেলেন। তার মুখ থেকে কোনো কথাই বেরোল না। নুরুন্নাহার বানু ধমক দিয়ে বলল :
কী মিয়া চুপ করে আছ যে, কথাটা বুঝি মনে ধরল না?
সালামত মিয়া আমতা আমতা করে বললেন :
-বেগম সাহেবা তরিতরকারি লাগানো খুব ভালো। আর এইটা সিজনও। আমি আপনাকে পেছনে একটা তরকারির বাগান করে দেব। অনেক জমি আছে।
–কেন মিয়া সামনে লাগালে কী ক্ষতি। তরকারি বাগান সামনেই করো।
–না বেগম সাহেবা সামনে তরিতরকারির বাগান করা যাবে না।
–কেন যাবে না শুনি। আমি বলছি সামনেই করো।
–বেগম সাহেবা এ বাড়িতে সামনে তরিতরকারি লাগানোর নিয়ম নেই। আপনি নতুন এসেছেন তাই বুঝতে পারছেন না।
–কী বললে মিয়া?
–বেগম সাহেবা আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আপনার এ হুকুম তামিল করতে পারব না।
সালামত মিয়ার কথা শুনে নুরুন্নাহার বানুর পায়ের তলা থেকে মাথার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে উঠল । দাঁতে দাঁত চেপে তিনি একরকম দৌড়েই বাড়ির ভেতর গিয়ে ঢুকলেন। ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে পা দিয়েই তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এই সাত সকালে পাঁচ পাঁচজন মানুষ ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। তারা নুরুন্নাহার বানুকে উঠে সালাম দিলেন। তিনি কোনোরকমে সালামের জবাব দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তিনি দেখলেন, নতুন স্যুট টাই পরে আবু জুনায়েদ অপর দরজা দিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করছেন। নুরুন্নাহার বানুর একচোট মনের ঝাল ঝাড়ার ইচ্ছে ছিল। সেটাই মাঠে মারা গেল। তারপরে তিনি কৌতূহলবশত ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখেন, সকালের নাস্তা দেয়া হয়েছে। আবু জুনায়েদ নাস্তা খাওয়ার সময় পাননি, তাকে জামা কাপড় পরে বের হতে হয়েছে। তখনই নুরুন্নাহার বানুর মনে পড়ল মানুষটা গত রাতেও কিছু খায়নি। আর এই সকালে চলে গেল । স্বামীটির প্রতি তার মনে এক ধরনের মমতা জন্মাতে লাগল। মানুষটা বোকাসোকা। খুব সহজেই তাকে ঠকানো যায়। তার সরল-সহজ স্বামীটিকে কোন ধুরন্ধর কোন বিপদে ফেলে দেয়, সে আশঙ্কায় তার মনটা গুড়গুড় করে উঠল । নুরুন্নাহার বানু মনে করেন, তিনি জীবনে যত জায়গা দেখেছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জায়গা। হঠাৎ অনেকদিন বাদে তার ইচ্ছে হলো, বেলা হয়ে গেলেও তিনি ফজরের নামাজটা পড়বেন।
সেদিন দিবানিদ্রা শেষ করে আবু জুনায়েদ বিছানায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে কি একটা বিষয় চিন্তা করছিলেন, এমন সময় নুরুন্নাহার বানু ঢুকলেন। তার মনে একটুখানি অনুশোচনার মতো হয়েছিল। তবে রাগটা পুরোপুরি মরেনি। আবু জুনায়েদের সঙ্গে দুটো মিষ্টি কথা বলার ইচ্ছে তার মনের মধ্যে জন্মেছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আর কি নিয়ে আলাপটা শুরু করবেন, বিষয় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ওগো আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে না দেখলে মনটা আমার কেমন করে, এসব কথা বলার বয়েস কি নুরুন্নাহার বানুর আছে? যখন তরুণী ছিলেন তখনো তিনি এ জাতীয় কথাবার্তাকে ন্যাকামি মনে করতেন। অনেক চিন্তা ভাবনা করে তিনি মুখ দিয়ে কথা বের করলেন :