আবু জুনায়েদ তার মুখে হাতচাপা দিয়ে বললেন :
–একটু ঠাণ্ডা হও, এসব আবোল-তাবোল কী বলছ?
নুরুন্নাহার বানু হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে আরো জোরে চিৎকার করে বললেন :
–আমি ঠাণ্ডা হলে তোমার খুব আনন্দ হয়, না? আমি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব । আমার আম্মাকে, ভাইকে ডাকব । তোমার মেয়ে জামাই সবাইকে খবর দিয়ে এনে সকলের সামনে প্রমাণ করব, রাতের বেলা তুমি ওই কসবি দিলরুবার সঙ্গে কোথায় কোথায় মজা করতে যাও। ঘরে মেয়ে আছে, মাগীর সে কথাটাও মাথায় আসেনি। টেলিফোন করে বলবে স্যারকে চাই।
আবু জুনায়েদ নুরুন্নাহার বানুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, দেখো এসব কথা তুমি মন থেকে বানিয়ে বানিয়ে বলছ, আমি গাড়ি করে তোমার ভায়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম । তুমি টেলিফোন করে দেখো।
ধার্মিক সাজার চেষ্টা করবে না। তোমাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনেছি। কতদিন থেকে ওই কসবির সঙ্গে তোমার লীলা চলছে?
কার কথা বলছ, আমি কোনো মহিলাকে চিনি না, কারো সঙ্গে আমার কোনো রকমের সম্পর্ক নেই।
এবার নুরুন্নাহার বানু আবু জুনায়েদের চোখে চোখ রেখে বললেন, তুমি বলতে চাও, তোমার সঙ্গে দিলরুবা খানমের গোপন পীরিত নেই?
–ছি ছি কী বলছ তুমি? চুপ করো । দারোয়ান বেয়ারা শুনলে কী বলবে?
নুরুন্নাহার বানু কণ্ঠস্বর আরো বাড়িয়ে বললেন, আমি সকলকে ডেকে শোনাব। ওই মাগী দিলরুবা টেলিফোনে আঁকু পাঁকু করে বলে কেন, স্যারকে চাই? এই রাতে স্যারকে কেন চাই? নুরুন্নাহার মুখের একটা ভঙ্গি করলেন। আবু জুনায়েদ এবার উপলব্ধি করতে পারলেন, তার দুর্ভোগের এই সবে শুরু। নুরুন্নাহার বানু কাটা কলাগাছের মতো ধপ করে বিছানায় পড়ে হাপুস-হুঁপুস করে কাঁদতে লাগলেন। তাদের চিৎকার সহ্য করতে না পেরে পাশের ঘর থেকে মেয়েটি বেরিয়ে এসে বলল :
আব্বা আম্মা আধারাতে তোমরা এসব কী শুরু করে দিয়েছ? সব কথা সব লোক শুনছে। কাল থেকে পাড়ায় মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। সে বাতি নিভিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
পরের দিন ভোর হওয়ার অনেক আগেই নুরুন্নাহার বানুর ঘুম ভেঙে গেল । আসলে সারা রাত তিনি দুচোখ এক করতে পারেননি। তার বুকের ভেতরটা জ্বলেছে। এবার থেকে তার পরাজয়ের পালা শুরু হলো। তার স্বামীর পদোন্নতি হওয়ার সংবাদ শোনার পর থেকে সকলের কাছে বলে বেড়াচ্ছিলেন, তার ভাগ্যেই, আবু জুনায়েদের জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। সে কথা মনে হওয়ায় এখন নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করল । মোল্লা আজান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। আবু জুনায়েদ বাম কাত হয়ে শুয়ে আছেন। তার নাক ডাকছে। নুরুন্নাহার বানু মনে করতে থাকলেন ওই মানুষটাই তার সারা জীবনের সমস্ত দুর্ভাগ্যের কারণ। মশারির বাইরে এসে স্পঞ্জে পা ঢুকিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে অনুভব করলেন, তিনি ভীষণ ক্ষুধার্ত। তক্ষুনি তার মনে পড়ে গেল গত রাতে তিনি কিছু মুখে তোলেননি। ডাইনিং রুমে এসে দেখেন গত রাতের ঢাকা দেয়া খাবার তেমনি পড়ে আছে। তিনি বাথরুমে গিয়ে মুখ হাতে পানি দিয়ে খেতে বসে গেলেন। ক্ষুধাটা পেটের ভেতর হুংকার তুলছিল। তাই বাসী ভাতে আটকালো না। ঢকঢক পানি খেয়ে নিয়ে কিচেনে ঢুকে এক কাপ চা করে আস্তে আস্তে খেতে লাগলেন। চা খাওয়া হয়ে গেলে তিনি হুড়কো খুলে বাইরে চলে এলেন। অল্প অল্প শীত করছিল। তাই একটি হাল্কা চাদর পরে নিয়েছিলেন। প্রথম সূর্যের আলো গাছপালার উপর এসে পড়েছে। ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুগুলো টলটল করছে। অনেকদিন এমন নরম তুলতুলে ভোর দেখেননি। তিনি বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ির চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। হঠাৎ তার মনে একটা অনুভূতি জন্ম নিল, সঙ্গে আবু জুনায়েদ থাকলে বেশ হতো। তক্ষুনি গত রাতে যেসব ঘটনা ঘটেছে একটা একটা করে সবগুলো মনে পড়ে গেল। তিনি নিজের মনে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করতে লাগলেন, ছোটলোক, ছোটলোক। এই ছোটলোকটাই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে । গত রাতে আবু জুনায়েদকে যে সকল হুমকি দিয়েছিলেন, সেগুলো মনে এল। তিনি তার আম্মা, ভাই এবং নিজের মেয়েকে ডেকে এনে যেসব কথা ফাঁস করবেন বলে ভয় দেখিয়েছিলেন, সেগুলো নিয়ে মনের ভেতর খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন। তার মনে হলো যেসব করবেন বলে রাগের মাথায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই প্রভাতের আলোতে মনে হলো তার কোনোটা করাই তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার মুখটা তেতো হয়ে গিয়েছিল । ছোটলোক, তার ঠোঁটে আপনিই মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হতে থাকল।
মনের মধ্যে অশান্তি, তবু সকাল বেলাটা তার মন্দ লাগছিল না। এইরকম ভোর তার জীবনে আর কখনো আসেনি। তিনি মস্ত কম্পাউন্ডটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। এরই মধ্যে একটা বেলা হয়েছে। দারোয়ান ঘটাং করে লোহার গেট খুলে ফেলেছে । ঝাড় হাতে, খুন্তি হাতে একদল মেয়ে পুরুষ কম্পাউন্ডের ভেতরে প্রবেশ করল । নুরুন্নাহার বানু পায়ে পায়ে গেটের কাছে চলে এলেন। ঝাড়অলা ঝড় তুলে, খুন্তি অলা খুন্তি তুলে সালাম দিল । নুরুন্নাহার বানুর নিজেকে তখন রাণী মনে হচ্ছিল । তিনি খুব খুশি হয়ে উঠেছিলেন। তথাপি তার মনের মধ্যে একটা খুঁত থেকে গেল। তার ইচ্ছে হলো বিষয়টা তিনি বুঝিয়ে দেবেন। পরক্ষণে চিন্তা করলেন, এসকল ছোটলোককে ভালো কিছু শিখিয়ে লাভ হবে না।