সন্ধ্যেবেলা বেয়ারারা সবগুলো কক্ষের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। পয়লা নুরুন্নাহার ভাবলেন, অত আলোর কী দরকার। বেহুদা মোটা বিল আসবে। নিজ হাতে নিভিয়ে দিতে গিয়ে থেমে গেলেন। জ্বলুক বাতি জ্বলুক। তাদের তো আর বিল দিতে হবে না। বাতি জ্বালাবার পর তার চোখে একটা নতুন জিনিস ধরা পড়ল । উপাচার্য ভবনের রুমগুলো সত্যি প্রকাণ্ড। আবু জুনায়েদের ঘাড়ে ঠেলা দিয়ে বললেন, দেখেছ কত বড় একেকটা রুম। ফুটবল খেলার মাঠের মতো। আবু জুনায়েদ এবার একটা লাগসই জবাব দিতে পারলেন। টুটুলকে নিয়ে এসো। সারা দিন ঘরের মধ্যে ফুটবল খেলবে। টুটুল তাদের নাতি । কথাটা নুরুন্নাহারের মনে ভীষণ ধরে গেল । স্বামী-স্ত্রী দুজন ঠিক করলেন, রেবাকে তার বর এবং টুটুলসহ এসে কিছুদিন থেকে যাওয়ার জন্য খবর দেয়া হবে। প্রস্তাবটি শুনে নুরুন্নাহার বানু উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। এতদিনে তার প্রাণপ্রিয় নাতিটির হেসে খেলে বেড়াবার একটা ব্যবস্থা হলো ।
তারপর আবু জুনায়েদ এবং নুরুন্নাহার বেডরুমে গিয়ে ঢুকলেন। মেহগনি কাঠের কারুকার্য করা খাট দেখে নুরুন্নাহার বানুর খুশিতে একেবারে ফেটে পড়ার অবস্থা। দেখেছ দেখেছ কত বড় খাট, আর কী সুন্দর! তারপর গলায় একটা কৃত্রিম বিষণ্ণতা সৃষ্টি করে বললেন, কিন্তু মুশকিলের কথা হলো কী জানো, এই এতবড় খাটে ঘুমালে আমি অন্ধকারে তোমাকে খুঁজে বের করতে পারব না। নুরুন্নাহার বানুর জবাব দিতে গিয়ে আবু জুনায়েদ একটা বেফাঁস কথা বলে ফেললেন। খুঁজে পেয়েও লাভ কী? তোমার কী আছে? কথাটি মুখ থেকে কেমন করে বেরিয়ে এল জুনায়েদ টেরও পাননি। নুরুন্নাহার বানু সাপিনীর মতো উদ্যত ফণা তুলে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে তুমি?
আবু জুনায়েদ বুঝতে পারলেন, ভারি অন্যায় করেছেন। এখন বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তিনি তাড়াতাড়ি বেডরুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলেন এবং বেয়ারাকে বললেন, ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো। ড্রাইভার গাড়ি বের করলে আপাতত তিনি পালিয়ে বাঁচলেন।
নুরুন্নাহার বানু কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এই প্রথম অনুভব করলেন আবু জুনায়েদের জিহ্বায় অতি অল্প সময়ে শান পড়তে আরম্ভ করেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নার দিকে তাকালেন। নিজের ছবি দেখে ঘুষি মেরে আয়নাটা ভেঙে ফেলার ইচ্ছে হচ্ছিল। এই সময়ে ড্রয়িং রুমে টেলিফোনটা বেজে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি নুরুন্নাহার বানু টেলিফোনটা ধরে জিজ্ঞেস করলেন :
হ্যালো কে কথা বলছেন?
ওপার থেকে নারীকণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল, ভি . সি. স্যার আছেন?
না, নেই, খুব ভারী এবং গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন নুরুন্নাহার বানু।
কবে পাওয়া যাবে?
কেন আপনার কী দরকার?
আমি তার ডিপার্টমেন্টের একজন কলিগ, একটু কথা ছিল। ওপার থেকে জবাব এল।
কী নাম আপনার?
আমার নাম দিলরুবা খানম।
নামটি শোনামাত্র নুরুন্নাহার বানু টেলিফোনে চিৎকার করে উঠলেন :
আমার স্বামীর সঙ্গে, আপনি রাতের বেলা কী কথা বলতে চান? শুনুন দিলরুবা খানম, আপনাকে আমি চিনি। ঘাড় মটকানোর মতো অনেক যুবক পুরুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের কারো একজনের ঘাড়ে বসুন, আমার সংসারটির এমন সর্বনাশ করবেন না। আর কথা নয়। টেলিফোন রাখলাম।
উপাচার্য ভবনের প্রথম রাতটি আবু জুনায়েদের জন্য ছিল অগ্নি পরীক্ষার রাত । রাত দশটার দিকে বাইরে থেকে ফিরে এসে দেখেন ঢাকা দেয়া ভাত তরকারি পড়ে আছে। নুরুন্নাহার বানু ছুঁয়েও দেখেননি। আবু জুনায়েদের বুকটা কেঁপে গেল। সরাসরি বেডরুমে প্রবেশ করতে সাহস হলো না। তিনি বাঁ দিকে বাঁক ঘুরে মেয়ের ঘরে গেলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, তুমি খেয়েছ দীলু?
হ্যাঁ বাবা কবে। মেয়ে জবাব দিল ।
তোমার মা খায়নি কেন বলতে পার, অসুখ-বিসুখ করেনি তো?
আব্বা মেজাজ খারাপ করাটাই মার স্বভাব। কী হয়েছে আমি বলতে পারব না । এসব তোমাদের ব্যাপার, তোমরা দেখবে। আমাকে টানতে চেষ্টা করছ কেন? আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে, আমি এখন ঘুমোব ।
অগত্যা আবু জুনায়েদকে বেডরুমে প্রবেশ করতে হলো। দেখেন নুরুন্নাহার বানু মেহগনি কাঠের অপূর্ব কারুকার্যময় খাটে বাঁকা হয়ে শুয়ে আছেন। তিনি কপালে হাত দিলেন। জ্বরজ্বারি কিছু নয়। অসুখটা অন্য জায়গায়। তিনি আস্তে আস্তে নুরুন্নাহার বানুর শরীরে হাত বুলিয়ে ডাকতে লাগলেন :
এই ওঠো খাবার পড়ে আছে। অনেক রাত এখন। সারা দিন তো কম ধকল যায়নি। নুরুন্নাহার বানু কোনো সাড়াশব্দ করলেন না। যেমন ছিলেন তেমনি শুয়ে রইলেন। আবু জুনায়েদ আরো একটু জোরে ঠেলা দিয়ে তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য ডাকাডাকি করতে থাকলেন। নুরুন্নাহার বানু এবার হাউমাউ করে কেঁদে বিছানার উপর উঠে বসলেন। তারপর চিৎকার করে বলতে লাগলেন :
আমার আব্বা তোমাকে পড়ার খরচ না যোগালে আজ তুমি কোথায় থাকতে? আব্বা নিজের কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে ওরকম একজন ছোটলোকের কাছে তোমার আদরের মেয়েকে তুলে দেয়ার বদলে তাকে খুন করে ফেললে না কেন? তোমার কাছে হাত পাতা মেনি বেড়ালটির সাহস কতদূর বেড়েছে আর ঘাড় কতটা মোটা হয়েছে তুমি নিজের চোখে দেখে যাও । আজ সে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বেড়ায়। রাতের বেলা গাড়ি করে তার মেয়েমানুষদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আব্বা তোমার ছোট মেয়ের কপালে আল্লাহ কী দুঃখ লিখেছে দেখে যাও ।