শেখ তবারক আলী বললেন-
-আপনার শখটি খুব উত্তম শখ। গাই গরু পোষা সৌভাগ্যের লক্ষণ। শুনে আমার খুব ভালো লেগেছে। মেয়ে নাতনি জামাইকে একটা কিনে দেয়ার তৌফিক আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু একটি কথা। গরু যে কিনবেন, রাখবেন কোথায়, চিন্তা করেছেন?
-না সে ব্যাপারে একেবারে কিছুই চিন্তা করিনি। আপনার চাষবাসের কথা শুনে আমার গরু পোষার কথাটা মনের মধ্যে জেগে উঠল । আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল গরু পুষতে গেলে গোয়াল আগে।
আবু জুনায়েদ একটুখানি নিরাশ হয়ে পড়লেন। শেখ তবারক আলীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবু জুনায়েদের মুখের ভাব লক্ষ্য করে বললেন:
ঠিক আছে গরু আর গোয়ালের ভাবনা আপনাকে ভাবতে হবে না। কাল নটার দিকে আমার মিস্ত্রি আপনার বাড়িতে যাবে, কোথায় গোয়াল ঘর বানাতে চান, জায়গাটা দেখিয়ে দেবেন, বাকি দায়িত্ব মিস্ত্রির। তারপর বললেন, চলুন একটু ভেতরে যাই, ছেলে মেয়ে, বউ এবং আপনার চাচীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই ।
ভেতরের ঘরে গিয়ে শুনলেন, শেখ তবারক আলীর ছেলে দুজন অধিক রাত হচ্ছে দেখে চলে গেছে। তাদের একজন থাকে গুলশানে, অন্যজন বারিধারায়। যে নাতিটির আকিকা উপলক্ষে যাওয়া, তাকে দোয়া করার সুযোগও পেলেন না আবু জুনায়েদ। ইঞ্জিনিয়ার মেয়ে তাহমিনা, তার স্বামী আবেদ এবং শেখ তবারক আলীর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হলো। আবু জুনায়েদের ইচ্ছে করছিল, এই বুড়ো মহিলার পদধূলি নেবেন। উপাচার্যের পোশাকটা তাকে এটা করতে দিল না। শেখ তবারক আলী তার স্ত্রীকে বললেন
-এই হলো মা বানুর স্বামী আমার উপাচার্য জামাই।
আবু জুনায়েদ সালাম করলেন।
-সুখে থাক বাবা। বললেন মহিলা।
আবু জুনায়েদের মেয়ে দীলু হরিণ শিশুর মতো ছুটোছুটি করছিল। আবু জুনায়েদের গা ঘেঁষে আবদেরে গলায় বলল
-এই দেখো আমাকে এবং মাকে নানি কী সব দিয়েছেন।
দীলু বাক্স খুলে দেখালো তাকে সোনার লেডিজ ঘড়ি, পার্কার ফাউন্টেন কলম, একটা চমৎকার বেনারশী শাড়ি এবং নুরুন্নাহার বানুকে দেয়া জড়োয়া গয়নার সেটটি দেখালেন।
-এসব দিতে গেলেন কেন? আবু জুনায়েদের কেমন বাধোবাধো ঠেকছিল।
শেখ তবারক আলীর স্ত্রী নরম সুরে বললেন-
-জামাই মিয়া এগুলো মেয়ে নাতনির কাছে নানির সামান্য উপহার ।
সে রাত্রে ফিরে আসার সময় নুরুন্নাহারের ঠোঁটে তবারক চাচার কথা লেগেই রইল । ভীষণ আকর্ষণীয় এবং খুশি খুশি দেখাচ্ছিল তাকে।
ব্রিটিশ স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শন উপাচার্য ভবনটিতে নুরুন্নাহার বানু, কলেজগামী কন্যা এবং ছোঁকড়া চাকরটি নিয়ে উঠে আসার পর মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ পূর্বে চিন্তা করেননি এমন কতিপয় অসুবিধের সম্মুখীন হতে থাকলেন। উপাচার্য ভবনে পা দিয়েই নুরুন্নাহার বানু এমন সব মন্তব্য করতে থাকলেন সেগুলো আবু জুনায়েদের মতো গোবেচারা স্বামীর পক্ষেও পরিপাক করা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ মনেপ্রাণে নিজেকে বদলে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। নিজের উপর আস্থার অভাব ছিল, সেটুকু কাপড়চোপড় দিয়ে চাপা দেয়ার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। উপাচার্য হিসেবে প্রথম মাসের মাইনেটি পাওয়ার পূর্বেই দু-দু-জোড়া স্যুট তিনি শহরের সেরা টেইলারিং হাউস থেকে আর্জেন্ট অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়েছেন। এক ডজন নানা রঙের টাই সংগ্রহ করেছেন। আবু জুনায়েদ মাঝে-মধ্যে ধূমপান করেন। কিন্তু শুনেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজ উপাচার্য লরেন্স সাহেব সব সময় পাইপ টানতেন। পাইপ মুখে থাকলে লরেন্স সাহেবের মুখমণ্ডল ভেদ করে আশ্চর্য একটা ব্যক্তিত্বের প্রভা বিকিরিত হতো। তিনি সামনের দেয়ালে উপাচার্যের প্রতিকৃতিসমূহের মধ্য থেকে পাইপ মুখে দণ্ডায়মান লরেন্স সাহেবের সঙ্গে মনে মনে নিজের তুলনা করছিলেন। টানতে পারবেন কি না বলতে পারবেন না তথাপি তিনটি পাইপ এবং টোবাকোও তিনি কিনে ফেলেছেন। ঘোড়ার রেস খেলার জকিদের পোশাক থাকে, ফুটবল ক্রিকেট খেলোয়াড়েরাও নিজেদের পোশাক পরে। এমনকি মসজিদের ইমামেরও একটা বিশেষ পোশাক আছে, যা পরলে চেনা যায় ইনি একজন ইমাম সাহেব, কোর্টের উকিল জজদের তো কথা নেই। সুতরাং উপাচার্যের নিজের একটা পোশাক থাকবে না কেন? বিশ্ববিদ্যালয় বিধিমালায় না থাকুক তিনি নিজেকে বিশেষ পোশাকে মডেল উপাচার্য হিসেবে হাজির করবেন ।
আবু জুনায়েদের মধ্যে যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে চলছিল এই প্রক্রিয়াটিতে নুরুন্নাহার বানু একটা মূর্তিমান বাধা হয়ে দেখা দিলেন । আবু জুনায়েদ দুরকম সংকটের মধ্যে পড়ে গেলেন। দিলরুবা খানম যদি হস্তক্ষেপ না করতেন, চেষ্টা চরিত্র করে হয়তো মাতৃগর্ভে প্রবেশ করতে পারতেন। কিন্তু উপাচার্য হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না। দিলরুবা খানম এই মেন্দামারা মানুষটির সাজ-পোশাকের বহর দেখে সকলের কাছে তাকে দরজির দোকানের ডামি বলে বেড়াতে আরম্ভ করেছেন। এই মহিলা যিনি বলতে গেলে একবারে অবজ্ঞেয় অবস্থা থেকে তাকে উপাচার্যের চেয়ারটিতে হাতে ধরে বসিয়ে দিয়েছেন, তার মতামতের নিশ্চয়ই মূল্য আছে।
এদিকে নুরুন্নাহার বানু ভিন্ন রকম উৎপাত শুরু করে দিয়েছেন। উপাচার্য ভবনে পা দেয়া মাত্রই এমন সব কাজ করতে লাগলেন এবং এমন সব মন্তব্য ছুঁড়তে থাকলেন, পদে পদে আবু জুনায়েদকে নাকাল হতে হচ্ছিল। সকাল বেলা উপাচার্য ভবনে প্রবেশ করেছেন, সেই বিকেলেই ড্রয়িং রুমে কয়েকজন জুনিয়র শিক্ষককে নিয়ে চা খেতে বসেছেন। এই সময়টিতে একজন জুনিয়র শিক্ষককে ডেকে মন্তব্য করে বসলেন, আচ্ছা ওই বাড়িটার ছাদ অত উঁচু করা কি ঠিক হয়েছে? আর দেয়ালগুলোও অত পুরু কেন? অনর্থক অনেক টাকার বাজে খরচ করা হয়েছে । অনায়াসে দোতলা বানানো যেত। দেখুন না দেয়ালগুলো কী রকম পুরু। একটু কম পুরু করে বানালে তিনটা বাড়ি বানানো যেত। একজন মাঝবয়েসী শিক্ষক নুরুন্নাহার বানুকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন, বেগম সাহেবা এটা এক ধরনের বাড়ির নির্মাণ পদ্ধতি। এটাকে গথিক বলা হয়। এই ধরনের বাড়িগুলো এরকমই হয়ে থাকে। নুরুন্নাহার বানু মনে করলেন, শিক্ষকটি সকলের সামনে তাকে হেয় করার জন্য গথিক ধাঁচের কথা বলেছেন। তিনি মনে করলেন, এটা এক ধরনের অপমান। তিনি জবাব দিলেন, আপনি কি মনে করেন, আমি দালানকোঠার কিছুই বুঝিনে, আমার আব্বা সারা জীবন ঠিকাদারি করেছেন, এখনো আমার ভাই সি. এন্ড বি, হাউজিং কর্পোরেশন এবং রোডস এন্ড হাইওয়েজের ফার্স্ট ক্লাস কন্ট্রাক্টর। আমাকে আপনার বাড়ি চেনাতে হবে না। জবাব শুনে সকলকে চুপ করে যেতে হলো। তারপরে কথার গতি কোনদিকে যেত বলা যায় না। চারজন ডীন গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানাতে এলেন। উনারা সকলে ডোরাকাটা দলের সমর্থক। আগে যদি তাদের জানা থাকত আবু জুনায়েদ মিয়া তাদের কাঁধের উপর পা রেখে উপাচার্য হয়ে বসবেন এবং তাদের ফুলের তোড়া দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাতে হবে, তাহলে কাঁচা বাজারের থেকে ফেরার পথে তাকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলতে ইতস্তত করতেন না। যা হোক, প্রবীণ শিক্ষকদের আগমনে পরিবেশ আবার হাল্কা হয়ে এল।