আবু জুনায়েদ শেখ তবারক আলীর মধ্যে ক্রমাগত সমুদ্রের গভীরতা আবিষ্কার করছিলেন। যতই শুনছিলেন তিনি যেন তলিয়ে যাচ্ছিলেন। তার দেশপ্রেমের সংবাদ যখন জানতে পারলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা অনেক গুণেই বেড়ে গেল। জর্দার নেশায় তার মাথাটা একটু একটু ঘুরছিল। উত্তর দিকের জানালা খুলে তিনি মুখের পিকটা ফেলে এলেন। রুমালে মুখ মুছে তিনি বললেন-
-এবারে আপনার সম্বন্ধে কিছু বলুন। আপনি কত ধরনের ব্যবসা করেন।
শেখ তবারক আলী বললেন-
-আমি নেহায়েতই চুনোপুটি। ঠিকাদারি দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখনো ঠিকাদারি আঁকড়ে ধরে রয়েছি। ছেলেমেয়েরা এটা ওটা বানাবার জন্য শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার কথা বলে। আমি কোনোরকমে বুঝিয়ে সুজিয়ে বারণ করে রেখেছি। আমি বলি বাবা ওদিকে যাবে না, গেলে মারা পড়বে। ঠিকাদারী না করতে চাও ট্রেডিং করো, বিদেশ থেকে সিমেন্ট আনন, গাড়ি আনো যা প্রাণ চায় আনো এবং বাজারে বেচো। মুনাফা বেশি না হোক তোমার মূলধন মারা যাবে না। তুমি কলকারখানা বসিয়ে কিছু একটা বানাতে গিয়েছ কি মরেছ। কে কিনবে তোমার জিনিস। হাল আমলের ছেলে সব সময় বুড়ো বাপের কথা শুনতে চায় না। তিনি আরো জানালেন, শুধু নগদ টাকা থাকলেই ব্যবসা হয় একথা মোটেই ঠিক নয়। তোমার ধৈর্য থাকতে হবে, মেজাজ থাকতে হবে এবং পরিশ্রম করার অভ্যেস থাকতে হবে। ব্যবসাও একটা এবাদতের মতো ব্যাপার। সকলকে দিয়ে ব্যবসা হয় না। মাঝে-মাঝে ছেলেদের মতিগতি দেখে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েন। জামাইটা ছিল বলেই ব্যবসাটা টিকে আছে। ভারি ঠাণ্ডা মেজাজের ছেলে। আর মাথাটাও খুব পরিষ্কার। তিনি জামাতার একটা সাম্প্রতিক বিচক্ষণতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন। ওয়াটার বোর্ড থেকে বুড়িগঙ্গা ড্রেজিংয়ের কন্ট্রাক্ট নিয়েছিল জামাই। পাশাপাশি পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে মীরপুরের নিচু জমি ভরাট করার কাজটাও আদায় করে নিয়েছিল। এখন বুড়িগঙ্গার ড্রেজিং করা মাটি দিয়েই নিচু জমি ভরাট করার কাজটি চলছে। নদী ড্রেজিং এবং নিচু জমি ভরাট করা দুটি মিশালে যে একটি চমৎকার বড় ব্যবসা হয়, এই জিনিসটি প্রথম জামাইর মাথায় এসেছিল। আড়াই কোটি এবং তিন কোটি টাকার কাজ। কোনোক্রমে যদি উঠিয়ে দিতে পারা যায় তাহলে তিন গুণ লাভ হওয়ার সম্ভাবনা। সব টাকা কি তিনি ঘরে তুলতে পারবেন? তিন ভাগের এক ভাগ রাঘব বোয়ালদের পেটেই চলে যাবে।
আবু জুনায়েদ শেখ তবারক আলীর মুখের কথা রূপকথার গল্পের মতো মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছিলেন। আর তার মুখের হাঁটি ক্রমশ বড় হয়ে যাচ্ছিল।
চাকর নতুন করে তামাক দিয়ে গেল। শেখ তবারক আলী দুটো এলাচদানা মুখে পুরলেন এবং গুড়গুড়িতে টান দিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন-দিনকাল পাল্টে যাচ্ছে। নতুন জমানার অনেক কিছুই বুঝিনে। ঠিকাদারিও আমাকে দিয়ে আর বেশি দিন চলবে না। বয়স তো হয়েছে। ছেলে এবং জামাইয়ের উপর ছেড়ে দিয়েছি, তারা যা পারে করবে। না পারলে করবে না। আমি এই বুড়ো বয়সে আবার বাপের পেশায় ফিরে যাচ্ছি। গুলশান এবং বাচ্ছার মাঝখানে আমার তিনশ বিঘার মতো জমি আছে। জায়গাটা জলা। সারা বর্ষাকাল পানির তলায় ডুবে থাকে। শীতের শেষে যখন পানি শুকিয়ে আসে বোরো ধান চাষ করি। হাজার দশেক মন ধান পাই। ঐ এলাকার গরিব লোকদের দিয়ে চাষ করাই। তারা কিছু নিয়ে যায়, আমি কিছু আনি। বর্ষাকালে সমস্ত বিলটা পানিতে যখন সয়লাব হয়ে যায়, আমার স্পীড বোটে চড়ে ঘুরে বেড়াতে বেশ লাগে। একবার সময় সুযোগ করে আপনাকে, মা বানুকে এবং আমার নাতনিকে ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখাব। আপনাদের ভালো লাগবে। এই জমিটার উপর দেশী-বিদেশী অনেকেরই কড়া নজর । অনেক দাম দিয়ে আমার কাছ থেকে কিনে নিয়ে দালান কোঠার কমপ্লেক্স বানাতে চায়। ছেলে এবং জামাই অনেকবার বলেছে ঐ জমি কিনে বেচে শিল্প-কারখানায় ইনভেস্ট করতে। আমি সাফ সাফ বলে দিয়েছি, আমার জীবদ্দশায় এটি হচ্ছে না। যতদিন বেঁচে আছি চাষ করে যাব।
আবু জুনায়েদ যখন শেখ তবারক আলীর মুখ থেকে শুনলেন বাচ্ছার মাঝখানে তার তিনশ বিঘে জমি আছে এবং সেখানে তিনি রীতিমতো ধান চাষ করেন, তার বুকের ভেতর জমির ক্ষুধাটা প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তার মনের একটা গোপন দরজা খুলে গেল। শরীরের সমস্ত রক্ত সভা করে উজানে উঠে আসতে চাইল। মুসা নবীর লোহিত সাগরের বুক দর্শন করে যে রকম অনুভূতি হয়েছিল সে রকম একটা ভাবাবেগ তার মনে ঢেউ খেলতে থাকল। মনে করতে থাকলেন, কামনা সমুদ্রের তীরে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। শেখ তবারক আলীকে স্বর্গ থেকে নেমে আসা আকাঙ্ক্ষা পূরণের বার্তাবাহক বলে ভাবতে থাকলেন।
শেখ তবারক আলীর তামাক ফুরিয়ে গিয়েছে। তিনি নলটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন। আবু জুনায়েদ অত্যন্ত বিনীতভাবে জানালেন-
-আমার একটি শখের কথা আপনাকে জানাতে খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু লজ্জা লাগে।
-স্যার, আপনি আমাকে এখনো আপনা মানুষ হিসেবে ভাবতে পারছেন না শুনে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। আপনি তো আবেদের মতো আমার আরেকজন জামাই। কীসের শখ আপনি মুখ খুলে জানাবেন। নইলে এ বুড়ো মানুষটি কষ্ট পাবে।
আবু জুনায়েদ এবার তার মনের কথা প্রকাশ করলেন।
-ছোটবেলা থেকে আমার একটা গাইগরু পোর খুব শখ। গোটা চাকরি জীবন তো ফ্ল্যাট বাড়িতে কাটাতে হলো। জায়গার অভাবে সে শখটা অপূর্ণ থেকে গেছে। এখন জায়গা আছে, ঘাসও বেশ আছে। আমার মনে হচ্ছে একটা গরু আমি পুষতে পারি। গরু কোথায় বেচাকেনা হয়, কীভাবে পছন্দ করে কিনতে হয় কিছুই জানিনে। আপনার হাতে লোকজন আছে, যদি একটা গরু দেখেশুনে কেনার ব্যবস্থা করে দিতেন। আপনার হাতে কি সেরকম সময় আছে?