-স্যার আপনি মাস্তান ছাত্র দুটোর কথা বলছেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ বছর ধরে কনস্ট্রাকশনের কাজ করছি। এরকম হারামজাদা মার কানের সোনা চুরি করে খায় যুবক আমি বেশি দেখিনি। কিন্তু কী করব। আমাকে তো এ কাজ করেই বেঁচে থাকতে হয়। এই গর্ভস্রাব হারামজাদাদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে চলবে কেমন করে। তারাই তো আজকের গোটা বাংলাদেশটা হাতের তালুর তলায় চেপে রেখেছে।
তারপর আবু জুনায়েদ হতবাক হয়ে শুনলেন। এই মাস্তানদেরকে শেখ তবারক আলীর মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে মাসোহারা দিতে হয়। তাছাড়া মদ, মেয়ে মানুষ, খাবার দাবার এটা সেটা কত কিছুর খরচ যোগাতে হয় তার কোনো হিসেব নেই। আরো জানতে পারলেন, ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো একটি দল জন্ম নিয়েছে। তাদের হাতেও পিস্তল কাটা রাইফেল ইত্যাদি আছে। এসব অস্ত্রশস্ত্র কোত্থেকে আসছে, তিনি ভালোরকম জানেন, কিন্তু প্রকাশ করেন না। কারণ তাতে বিপদের আশঙ্কা আছে। এই দলটির দাবি মেটাতে রাজি হননি বলেই সেদিন টেণ্ডার বক্স খোলার সময়ে ডান পায়ে ওভারসীয়রকে গুলি করেছিল। আবু জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলেন
-ওরাও কি আপনার কাছ থেকে টাকাকড়ি পায়?
-কিছু তো দিতে হয়। জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করব কেমন করে? বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন সবখানেই সন্ত্রাসীরা ছড়িয়ে আছে। এদের না হলে ক্ষমতাসীন দলের চলে না, বিরোধী দলের চলে না। ছোটখাটো রাজনৈতিক দলগুলোকেও মাস্তানির মাধ্যমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। আমি একজন সামান্য ঠিকাদার মানুষ আমি কোন সাহসে ওদের সঙ্গে বিবাদে নামব?
শেখ তবারক আলীও বোধহয় হুইস্কি পান করেছেন। আবু জুনায়েদ নিজের চোখে দেখেননি। কিন্তু মুখ থেকে ওরকম গন্ধ পাচ্ছিলেন। হুঁকোর নলে টান দিয়ে মাঝে-মাঝে চোখ বন্ধ করতে চেষ্টা করেন। ধোয়া ছেড়ে কথা বলতে থাকেন। নেশার ঘোরে কি না আবু জুনায়েদ বলতে পারবেন না, শেখ তবারক আলীকে কথা বলায় পেয়ে বসেছে। আবু জুনায়েদ রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ে শুনে যেতে লাগলেন।
শেখ তবারক আলীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার, সাব ইঞ্জিনিয়ার, ওভারসীয়র, কেরানী, একাউন্ট্যান্ট সবাইকে নিয়মিত পয়সা দিতে হয়। নয়ত তারা একটা অনর্থক ঘাপলা বাঁধিয়ে দেয়। বাজার থেকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাল কিনে দিলেও বাগড়া দিয়ে বসবে, বলবে ইট ভালো নয়, বালুর মধ্যে কাঁকড় আছে, রডগুলো মাপে দুই সুতো কম আছে। শেখ তবারক আলীর কাজ কী এই সমস্ত ছোটলোকের বাচ্চাদের সঙ্গে ঘাপলা করে। তাই কিছু কিছু দিয়ে ছোটলোকের বাচ্চাদের মুখ বন্ধ রাখতে হয়।
শেখ তবারক তামাক টানছিলেন। ফ্যানের বাতাসে কল্কে থেকে স্ফুলিঙ্গগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছিল। তার মুখ থেকে অবলীলায় কথা বেরিয়ে আসছিল। আবু জুনায়েদ এই প্রথম জানতে পারলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড ওভারসীয়র দেখতে যাকে মনে হবে মুসল্লী মানুষ, কপালে নামাজ পড়তে পড়তে দাগ পড়ে গেছে, এই শহরের নানা জায়গায় তার পাঁচটি বাড়ি এবং তিনটি দোকান আছে। ইচ্ছে করলে হেড ওভারসীয়র কফিল উদ্দিন পাঁচ পাঁচ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে মাইনে দিয়ে পুষতে পারে। দেখে কি চেনার কোনো উপায় আছে? আবু জুনায়েদ আরো শুনলেন, একজন উপাচার্য তার কাছ থেকে মেয়ের বিয়ের সমস্ত নিমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়ার খরচটা গলায় পা দিয়ে আদায় করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এত গলিখুঁজি বারান্দা, চোরাগলি, সুড়ঙ্গ, গোপন লেনদেনের এত পাকা বন্দোবস্ত দীর্ঘকাল থেকে তৈরি হয়ে রয়েছে এ ব্যাপারে আবু জুনায়েদ কিছুই জানতেন না। তার মনে হতে থাকল, এতকাল শূন্যের উপর ভেসে বেড়াচ্ছিলেন। শেখ তবারক আলীর কথায় হঠাৎ করে তার জ্ঞান নেত্রের উন্মীলন ঘটতে থাকল। তবারক আলী বলে যেতে লাগলেন, কর্মচারীরা এত টাকা আদায় করে নেয়, সে তুলনায় মাস্তানদের আর কত দিতে হয়। এরই মধ্যে টেলিফোনটা বেজে উঠল । শেখ উঠে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।
-স্যার আজ শুধু আপনার সঙ্গেই কথা বলব। টেলিফোন রিসিভ করব না। মনের কথা বলার মানুষ পাইনে। মাঝে-মাঝে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। দেশটা কোথায় যাচ্ছে। মোটা অঙ্কের টাকা সরকারি দলকে দিতে হয়। বিরোধী দলকে দিতে হয়। আমলাদের দিতে হয়, মাস্তানদের দিতে হয়। আমাদের মতো সৎ ব্যবসায়ী যারা পলিটিক্যাল ব্যাকিংয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়নি, ঘরের টাকা ঢেলে ব্যবসাপাতি করে থাকে, তাদের কি টিকে থাকার কোনো উপায় আছে? ব্যাংকগুলোতে গিয়ে দেখুন, ব্যাংকের ষাট ভাগ টাকা নানা রকম প্রভাব প্রতিপত্তি খাঁটিয়ে ফাটকাবাজ ব্যবসায়ীরা নিয়ে গেছে। কলকারখানার নাম করে টাকা নিয়েছে। গিয়ে দেখুন একটা কম্পাউন্ড ছাড়া কিছু নয় ভেতরে ফাঁকা। কোনো যন্ত্রপাতি বসেনি। ব্যাংক থেকে লোনটা নিয়ে প্রথম চোটেই গুলশান, বনানী কিংবা বারিধারায় বৌয়ের নামে বাড়ি বানিয়ে উপরতলা ভাড়া দিয়ে নিচের তলায় স্থায়ীভাবে বাস করার ব্যবস্থা করেছে, অধিকাংশ মানুষ। ব্যাংক যখন টাকা দাবি করে, সুদ দাবি করে, অজুহাত দেখিয়ে বসে লেবার ট্রাবলের জন্য প্রোডাকশন কিছুই হয়নি। সুতরাং সুদ মওকুফ করতে হবে। ব্যাংক যখন আসল দাবি করে, জবাব দেয় আপনারা গোটা কারখানাটাই নিয়ে যান। ব্যাংক যখন কারখানার দখল নিতে যায় দেখে লোনের টাকার দশ ভাগের এক ভাগও সেখানে বিনিয়োগ করা হয়নি। বাড়িঘর, নিলাম করে নেয়ার ক্ষমতাও ব্যাংকের নেই। এই হলো ব্যাপার, এভাবেই বাংলাদেশ চলছে। মাঝে-মাঝে ভাবি চাষারা লাঙলের মুঠি ধরে দেশটা টিকিয়ে রেখেছে। নয়ত অসাধু আমলা, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক এবং ফটকা ব্যবসায়ীরা দেশের সমস্ত মাটি মন মেপে বিদেশে চালান করে দিত।