সামনের ভদ্রলোকটিকে বললেন, আপনি একটু ওদিকের সোফাটায় বসুন দয়া করে। উপাচার্য সাহেবকে আমার কাছে বসতে দিন।
আবু জুনায়েদের জানু কাঁপছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে নিয়ে গেল। কোনো রকমে মন্ত্রী সাহেবের বিপরীত দিকের সোফাটিতে নিজেকে স্থাপন করলেন আবু জুনায়েদ। তার মনে প্রবল আতঙ্ক। কখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব বেয়াদবি ধরে বসেন। জেনারেল মানুষ। যদি রেগে যান। তরল পানীয়ের প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রী সাহেব দিলদরিয়া মেজাজে ছিলেন। পরিবেশনকারীকে হুকুম দিলেন
-ওখানে আরেকটা গ্লাস দাও। পরিবেশনকারী হুইস্কি কাজু এবং বরফ দিয়ে গেলে মন্ত্রী সাহেব নিজেই সোডার সঙ্গে হুইস্কি মেশালেন, তারপর কুচি ঢেলে দিয়ে বললেন-
-এবার চেখে দেখেন উপাচার্য সাহেব।
আবু জুনায়েদ মস্ত ফাঁপড়ে পড়ে গেলেন। জীবনে তিনি কোনোদিন মদ মুখে দেননি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অসন্তুষ্ট করার সাহসও তার নেই। তাই তিনি অত্যন্ত কাতর স্বরে বললেন
-স্যার জীবনে আমি কোনোদিন মদ খাইনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন-
-নাউ আই আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াই ইউ আর সো নার্ভাস। ইউ ডোন্ট নো হাউ টু থ্রো অ্যাওয়ে দ্য প্রেসার অব ওঅর্ক হ্যাজার্ড। প্লিজ হ্যাভ এ সিপ, এন্ড ইউ উইল ফিল হোয়াই ইট ইজ। বুঝলেন সব ফর্সা। সবকিছু ফর্সা। নো ভাবনা, নো দুশ্চিন্তা এন্ড এ ব্রিসফুল স্লিপ।
অগত্যা আবু জুনায়েদ গ্লাসটা তুলে একটা ঢোক গলার মধ্যে চালান করে দিলেন। তার মনে হলো পেটের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। বমি করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। অন্য জায়গায় হলে গলগল করে বমি করে দিতেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভয়ে মুখ দিয়ে বমি নির্গত হচ্ছিল না। তাকে উদ্ধার করলেন শেখ তবারক আলী। তিনি এগিয়ে এসে বললেন-
-জেনারেল সাহেব, উপাচার্য আমার ভাইঝি জামাই। অতি নির্মল স্বভাবের ছেলে। আপনার সঙ্গে পাল্লা দেয়া উনার কাজ নয়। তাকে মাফ করতে হবে।
শেখ তবারক আলী আবু জুনায়েদকে হাত ধরে টেনে নিয়ে সমাগত অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকলেন। অভ্যাগতদের মধ্যে তিনজন রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের মানেজিং ডিরেক্টর আছেন, দুজন মাননীয় সচিব, তিনজন শিল্পপতি, পুলিশের আইজি-এমনকি দুজন কুখ্যাত ছাত্রনেতাও রয়েছেন। তাদের একজনকে সম্প্রতি সরকারি ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং সে বিরোধী দলে যোগ দিয়েছে। অন্যজন বিরোধী দল সমর্থক। বিশ্ববিদ্যালয়ে টেণ্ডার বক্স দখল নিয়ে যত খুন জখম হয়েছে তার সঙ্গে এ দুজন একেবারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এই দুজনের চেলারা টেণ্ডার খোলার দিন একে অপরের মাথা ফাঁক করে ফেলতে উদ্যত হয়। অথচ এখানে দুজন টেবিলে মুখোমুখি বসে পরস্পরের সঙ্গে খোশগল্প করছে, যেন কতকালের বন্ধু। আবু জুনায়েদ তাদের টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো দুজনেই উঠে দাঁড়িয়ে খুব নরম স্বরে সালাম দিল। একজন তো বলেই বসল-
-স্যার আসবেন জানতাম, তবারক সাহেব আগে জানিয়েছিলেন।
অন্যজন হুইস্কির গ্লাসে ঝুঁকে পড়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায় কি না পরখ করে দেখছিল। সালামের জবাবে আবু জুনায়েদের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুল না । তিনি আমতা-আমতা করতে লাগলেন। একটা আড়ষ্টতাবোধে জিভটা শক্ত হয়ে রইল। শেখ তবারক আলী আবু জুনায়েদকে বললেন
-মা বানু আর তার মেয়ে নিশ্চয়ই একটুখানি ব্যস্ত রয়েছে। কতদিন পরে তার চাচীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। ছেলের বউ, মেয়ে সকলে এসেছে। একটু আমোদ আহ্লাদ, গাল-গল্প করবে। চলুন আমরা ততক্ষণ পাশের ঘরটাতে গিয়ে একটু কথাবার্তা বলি।
দরজা ঠেলে দুজন ছোট্ট ঘরটিতে ঢুকলেন। ছিমছাম সাজানো সুন্দর ঘর । একপাশে টেলিফোন, ফ্যাক্স মেশিন। ফটোকপিয়ার। শেখ তবারক বললেন
-স্যার এটা আমার অফিস ঘর। মতিঝিলে আরেকটা বড় অফিস আছে। আজকাল শরীরে কুলোয় না। বাইরে বেরোতে ক্লান্তি লাগে। বাড়িতে বসে যতটুকু পারি, কাজকর্ম দেখাশোনা করি।
আবু জুনায়েদ যতই দেখছিলেন অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্য তার জিভ চুলবুল করছিল। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই বসলেন।
-আজকে এখানে দুজন মাস্তান ছাত্রকে দেখলাম। তারাই তো টেণ্ডার ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। তারা কী করে আপনার এখানে এল?
শেখ তবারক আলী বললেন
-স্যার বলব, অনেক কথাই বলব। সেজন্যই তো এ ঘরে এসেছি। তার আগে একটু বেয়াদবি করব, যদি এজাজত দেন।
-আরে বলুন, আপনি এমন করে কথা বলেন আমি খুব বেকায়দায় পড়ে যাই।
শেখ তবারক আলী জানালেন, তিনি একটু তামাক সেবন করার ইচ্ছে করছেন। আবু জুনায়েদ যদি অনুমতি দেন, চাকরকে হুঁকা আনার হুকুম দিতে পারেন।
আবু জুনায়েদ বললেন-
-আপনি অবশ্যই তামাক খাবেন, তার জন্য অনুমতির কী প্রয়োজন। আপনি তো আমার মুরুব্বী ।
জবাব শুনে শেখ তবারক খুব খুশি হলেন। চাকরকে ডেকে তামাক আনতে হুকুম দিলেন। তারপর আবু জুনায়েদকে জিজ্ঞেস করলেন
-স্যার আপনাকে সিগারেট দিতে বলি।
-আমি সিগারেট খাইনে। একটু খয়ের জর্দা দেয়া পান হলেই আমার চলবে।
চাকর তামাক দিয়ে গেল। শেখ তবারক আলী একটা লম্বা টান দিয়ে ঢোক গিললেন। গলগল করে নাকমুখ দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন