-আপনার বাড়িটা দেখতে খুবই সুন্দর । অথচ হাল আমলের বাড়ির মতো নয়। এ ধরনের চৌকোণা চক মেলানো বাড়ি বানাবার কথা আপনার মনে এল কেমন করে?
ঠিক সেই সময়ে বিদ্যুৎ নিভে গেল। শেখ তবারক তার জামাতাকে বললেন :
-বাবা আবেদ, বাতি কখন আসে তার কোনো ঠিকানা নেই। ডায়নামোটা চালু করতে বলল।
আবু জুনায়েদকে বললেন :
স্যার একটা মিনিট দাঁড়াবেন দয়া করে। আগে আলোটা আসুক,
তারপর এ ধরনের অন্যরকম বাড়ি বানানোর খেয়াল কেন তার মাথায় চাপল সে কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন।
-আমি তাজমহলের সৌন্দর্য দেখে একরকম পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। প্রতি বছরই সুযোগ পেলে একবার আগ্রা ছুটে যেতাম। পাঁচ সাত দিন থেকে যেতাম। বার বার ঘুরে ফিরে তাজমহলের নির্মাণ কৌশল বুঝতে চেষ্টা করতাম। মোটামুটি একটা ধারণা যখন করতে পারলাম, আমার মাথায় একটা পাগলা খেয়াল চাপল। তাজমহলের নকশার একটা বাড়ি আমি নিজেই বানাব। এটা তো নিছক পাগলামী। কোথায় বাদশাহ শাহজাহান, কোথায় তবারক আলী আপনাদের মতো দশজনের দয়ায় কোনোরকমে দুটো ভাত খেয়ে টিকে আছি। আমার মনের কথাটা যখন আর্কিটেক্টদের কাছে খুলে বললাম, তারা মনে করলেন আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। কেউ কি তাজমহলের মতো বাড়ি বানাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে! আমি বললাম, কেন পারবে না, তাজমহল যারা বানিয়েছিল তারাও তো মানুষ। শাজাহানের তাজমহল বানানো সম্ভব নয় বুঝলাম, আমি বললাম আপনারা আমাকে একখানি তবারক আলীর তাজমহল বানিয়ে দেন। তা আর্কিটেক্টদের দিয়ে কিছু করানো গেল না। আমিও দমে যাওয়ার ছেলে নই। নিজে নিজে এই বাড়ির নকশা করেছি।
শেখ তবারক আলীর কথা শুনে আবু জুনায়েদের মনের মধ্যে একটা মস্ত ধাক্কা লাগল। তিনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন এই মানুষটির চিন্তার পরিধি কতদূর প্রসারিত। কিন্তু একটা ব্যাপারে তিনি ঠিক পাচ্ছিলেন না তাই জানতে চাইলেন :
-এত সুন্দর বাড়ি, ঢাকা শহরের একটা দর্শনীয় জিনিস। কিন্তু বস্তির ভিড় এবং ঝোঁপঝাড়ের কারণে বাড়ির চেহারাটি বাইর থেকে কারো নজরেই আসে না। এগুলো কি পরিষ্কার করা যায় না? আবু জুনায়েদ বললেন।
-স্যার কথাটা হলো সেখানেই। আমাদের এটা কি দেশ? এই দেশে কি মানুষ বাস করতে পারে? এখানে কি কোনো আইন-শৃঙ্খলা আছে? প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে লোকজন যখন আন্দোলন শুরু করল, পশ্চিম দিকের কম্পাউন্ড ওয়াল ভেঙে এক অংশে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। অনেক কষ্টে থামাতে পেরেছি। এরশাদ পাপ করেছে তবারককে কেন শাস্তি ভোগ করতে হবে? বোঝেন অবস্থাটা। আমরা ঠিকাদারি করে খাই। যে সরকারই আসুক না কেন আমাদের তো সম্পর্ক রাখতে হবে। সেবার তো একটা মস্ত শিক্ষা হলো। তারপর এই ঘরগুলো বানিয়ে গরীব মানুষদের থাকতে দিয়েছি। কারো কাছ থেকে ভাড়াপত্তার কিছুই আদায় করিনে। বিপদে-আপদে একটু সামনে এসে দাঁড়ায়।
তিন চার মিনিট শেখ তবারকের কথা শুনে আবু জুনায়েদের ইচ্ছে হলো তিনি তার পায়ের ধুলো নেবেন। সারা জীবন ধরে মনে মনে এরকম একটি মানুষের সন্ধান করছিলেন। তিনি যে তাকে অনুগ্রহ করে নিমন্ত্রণে ডেকেছেন, সেজন্য মনে মনে কৃতার্থ বোধ করলেন। এ সময়ে বাতি জ্বলে উঠল । তিনি ডায়নামোর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন।
শেখ তবারক তার জামাতা আবেদকে বললেন :
বাবা আবেদ তুমি মা বানু এবং আমার নাতনিকে ভেতরে নিয়ে যাও। আমি স্যারকে মেহমানদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
বড় হলো ঘরটিতে যখন ঢুকলেন আবু জুনায়েদের চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। হলভর্তি ছড়ানো সোফা সেট। অনেক মানুষ। কেউ হুইস্কি টানছেন, কারো সামনে বিয়ারের গ্লাস। আবু জুনায়েদের জন্য এটা একটা নতুন জগৎ। উপবিষ্ট অতিথিদের চেহারা দেখেই আবু জুনায়েদ অনুভব করতে পারলেন, এরা নিশ্চয়ই সমাজের কেষ্টবিষ্ট হবেন। মাত্র একজন ভদ্রলোককেই চিনতে পারলেন। তিনি হলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাদেক আলী খান। হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলেন আর ডানহিল টানছিলেন। আবু জুনায়েদ একটু অবাক হয়ে গেলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে তার তিনবার দেখা হয়েছে। প্রতিবারই বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে ডেকে নেয়া হয়েছিল। প্রতিবারই তিনি তাকে ইসলাম সম্পর্কে অনেক হেদায়েত করেছেন। বারবারই বলেছেন, ইসলাম থেকে সরে এসেছে বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অনাচার চলছে। আবু জুনায়েদের খুব ভয় হতে লাগল । যদি ক্ষমতা থাকত এক দৌড়ে তিনি এখান থেকে পালিয়ে যেতেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবকে হুইস্কি পান করতে দেখে তার মনে কোনো ঘৃণা জন্মেছে সে কারণে পালিয়ে যাওয়ার কথা তার মনে আসেনি। ইসলাম প্রচারক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবকে তিনি নির্জলা হুইস্কি পান করতে দেখেছেন মন্ত্রী সাহেব এটা জানতে পারলে তার ক্ষতি করতে পারেন এ আশঙ্কাই তার মনে জেগেছে। আবু জুনায়েদ একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব হুইস্কির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে তাকে আহ্বান করলেন
-এই যে উপাচার্য সাহেব, এদিকে আসুন। আপনার স্কুলে আজ কি ফুটুস ফাটুস কিছু হয়নি? বাচ্চালোগ সব শান্ত হয়ে গেছে।