-আপনি কি আমেরিকা থাকেন? আমেরিকা দেশটির প্রতি তার ভারি আকর্ষণ। ছোট ভাইয়ের বউয়ের ভাই আমেরিকার লসএঞ্জেলস শহরে থাকে। তাদের ফ্ল্যাটের উপরতলার কুদসিয়া বেগমের স্বামী সপ্রতি আমেরিকা থেকে গাড়ি, ফ্রিজ, ভিসিপি,ওয়াশিং মেশিন কত কিছু নিয়ে ফিরেছেন। নুরুন্নাহার বানুর কপালে বিদেশ দেখার সুযোগ নেই। যাক আবু জুনায়েদের সঙ্গে বিয়েটা যদি ডক্টরেট করার আগে হতো, অন্তত বিলেত দেশটা দর্শন করা থেকে তিনি বঞ্চিত হতেন না। এখন বিদেশের কথা উঠলেই চাপা দীর্ঘনিশ্বাস বুকের ভেতর জমিয়ে রাখেন। যা হোক,
ভদ্রলোক জবাব দিলেন :
-এখন চলে এসেছি, চার বছর ছিলাম। এবার কথোপকথনে আবু জুনায়েদ যোগ দিলেন।
-আমেরিকার কোন শহরে ছিলেন?
-এখানে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স শেষ করেছিলাম। ওখানে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে লেখাপড়া করেছি।
গাড়ি নিউমার্কেট ছাড়িয়ে গেছে। হঠাৎ আবু জুনায়েদের খেয়াল হলো, তবারক সাহেবের জামাতার নামটা জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন।
-ভাই তোমার নামটা জানা হয়নি। তুমি বললাম, রাগ করলে?
অল্প বয়সের কারো সঙ্গে আলাপ হলে আপনা-আপনি তুমি বেরিয়ে আসে, মাস্টারি করার এটাই দোষ।
-স্যার, তুমিই তো বলবেন। এক সময়ে আমি আপনার ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন ক্লাস করেছি। পরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেয়ে চলে গেছি। আমার নাম আবেদ হোসেন।
-আচ্ছা আবেদ তোমার সঙ্গে তবারক সাহেবের মেয়ের বিয়ে হয়েছে কতদিন?
-সে অনেক আগে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আমরা ক্লাসফ্রেন্ড ছিলাম।
-তোমার স্ত্রীও ইঞ্জিনিয়ার?
-হ্যাঁ স্যার ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করে।
আবু জুনায়েদ মনে মনে হিসেব মেলাতে চেষ্টা করেন । তিনি তবারক আলীকে শিক্ষা-সংস্কৃতিহীন সাধারণ একজন ঠিকাদার ধরে নিয়েছিলেন। পাজেরো গাড়ি, মার্কিন দেশ ফেরত জামাতা এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক কন্যার কথা শুনে শেখ তবারক আলী সম্পর্কে লালিত ধারণাটি ভেঙে যাচ্ছিল। নুরুন্নাহার বানুর মুখে তো কথাই নেই। তিনি ভেবেছিলেন, তবারক চাচাকে তাক লাগিয়ে দেবেন। সেটি আর হচ্ছে না বুঝতে পারলেন। আরো কত বিস্ময় তার জন্য অপেক্ষা করে আছে কে জানে।
আবু জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলেন :
-আবেদ তুমি কি চাকরি করো?
আগে তো আমরা হাজবেন্ড এন্ড ওয়াইফ এক সঙ্গে একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করতাম। কিন্তু আব্বা আমাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করলেন। আব্বার তাগিদেই
তো আমাকে আবার বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়শোনা করতে হলো।
-বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আমাদের সামান্য কাজ। আমরা চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করি। হাউজিংয়ে কাজ করি। রোডস এন্ড হাইওয়েজে কাজ করি। রিভার ড্রেজিং-এ কাজ করি।
আবু জুনায়েদের আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না। নুরুন্নাহার বানু জানতে চাইলেন :
-আপনার কয় ছেলেমেয়ে?
-আমার একটি ছেলে, একটি মেয়ে।
-কত বয়স?
-ছেলেটি কেজিতে পড়ছে। মেয়েটি দেড় বছরের।
গাড়ি সংসদ ভবন ছাড়িয়ে আগারগাঁওয়ের দিকে মোড় নিয়েছে। শেরে বাংলানগর এবং মীরপুরের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছে গাড়ি আবার বাঁ দিকে মোড় নিল। দুপাশে সার সার বস্তি। আবেদ হোসেন জানালেন আমরা এসে পড়েছি।
আবু জুনায়েদ ভাবলেন এত জায়গা থাকতে শেখ তবারক আলী এই নোংরা বস্তির মধ্যে বাড়ি করতে আসলেন কেন? আসলে ঠিকাদারদের যতই টাকা-পয়সা হোক, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায় না। কোটি টাকার মালিক হলেও নোংরা জিনিসের প্রতি আকর্ষণ তারা ছাড়তে পারে না। আবু জুনায়েদ এরকম এক বড়লোকের কথা শুনেছেন। বড় লোকটি বারে গিয়ে বিলেতি মদের বদলে বাংলা মদ পান করে। বারের পরিবেশনকারীর সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করে রেখেছে, সে পূর্ব থেকেই বাংলা মদ সংগ্রহ করে রাখে। এ কারণে সে মোটা বখশিস পায়।
একটা বিরাট গেটের কাছে এসে গাড়ি দাঁড়ালো। আবু জুনায়েদ লক্ষ্য করে দেখেন, বাড়িটির চারপাশে গোল কম্পাউন্ড। কম্পাউন্ডের প্রাচীর ঘেঁষে একটার পাশে একটা লাগানো ঘন বস্তির ভিড়। ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় গাছ মাথা তুলেছে। খুব ভালো করে না তাকালে কারো চোখে পড়ার কথাই নয়, এই সবের ভেতর একটা বড় বাড়ি আত্মগোপন করে আছে। বাড়িটার গেট পেরিয়ে কম্পাউন্ডের ভেতর প্রবেশ করল। আওয়াজ শুনে শেখ তবারক নিজে থেকে এগিয়ে এসে নিজে দরজা খুলে দিয়ে সালাম দিলেন।
-স্যার তাহলে এলেন, গরিবের বাড়িতে পায়ের ধুলো পড়ল। বানু মেয়ে আমার, নুরুন্নাহার বানুকে হাত ধরে নামালেন।’
আবু জুনায়েদের ইচ্ছে হলো বাড়িতে প্রবেশ করার আগে একটা বিষয়ে ফয়সালা করে ফেলবেন। তিনি শেখ তবারক আলীকে উদ্দেশ্য করে বললেন :
-আপনি আমার বয়সে বড়, মুরুব্বী, আমাকে স্যার বলেন কেন? তুমি বলবেন।
-জামাই বাবাজি ওই কথাটি বলবেন না। সবচাইতে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে আমি যদি স্যার না বলি আল্লাহতায়ালা অসন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহ আপনাকে ইজ্জত দিয়েছেন, আমি সম্মান না দেখানোর কে? আমার কপাল আমার কন্যার স্বামীকে আমি স্যার ডাকতে পারছি। গোফরান ভাই বেঁচে থাকলেও বাবা আপনাকে স্যার বলতেন। মা বানু জানে, আমরা দুজন একই মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো ছিলাম।
দুপাশে বাগান, মাঝখান দিয়ে পীচ করা রাস্তা। সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আবছা আলোতে সবকিছু ভালো করে দেখাও যায় না। বাড়ির কাছাকাছি এসে আবু জুনায়েদ শেখ তবারকের প্রতি একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।