নুরুন্নাহার বানু একজন মনের মতো মানুষের সন্ধান করছিলেন, যার কাছে হৃদয় বেদনার কথা প্রকাশ করে মনের ভার লাঘব করবেন। সুখ, ঐশ্বর্য, আড়ম্বর এসবের কথা কাউকে বলতে না পারা, তার বেদনা কী অল্প! আমি স্বর্গে গিয়ে আরাম-আয়েশ ভোগ করে লাভ কী, যদি আমার প্রতিবেশী সেগুলোর প্রতি ঈর্ষাতুর দৃষ্টিপাত না করে। সুতরাং নুরুন্নাহার বানু মনে মনে একজন মানুষের সন্ধান করছিলেন। তবারক চাচা নিঃসন্দেহে নুরুন্নাহার বানুর সেই মনের মানুষটি হবেন ।
ছোটবেলায় পাকা কুল খাওয়ার আবদার ধরে তাকে কুল গাছে চড়তে বাধ্য করেছেন। একবার পেয়ারা গাছে চড়তে গিয়ে ডাল ভেঙে পা মচকে গিয়েছিল । পছন্দমতো ফ্রক, সালোয়ার, কামিজ চাইতে গিয়ে আব্বা-আম্মার কাছে ধমক খেয়ে যখনই তবারক চাচাকে ধরেছেন, তিনি তাকে পছন্দসই জামা কাপড় কিনে দিয়েছেন। এরকম কত কাহিনী তার মনে পড়ে গেল। তিনি শেখ তবারক আলীকে টেলিফোনে জিজ্ঞেস করলেন :
-চাচা আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি। আপনার কতক্ষণ লাগবে?
-বানু, বেটি আমার, এত উতলা হওয়ার কী আছে? আমি তো সর্বক্ষণ তোমার বাড়ির পাশেই থাকি। যে কোনোদিন যাওয়া যাবে।
-তাহলে চাচা আপনি আজ আসবেন না? নুরুন্নাহার বানুর উৎসাহ-উদ্দীপনা দপ করে নিভে গেল। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, বসে পড়লেন। মনে হলো টেলিফোনের রিসিভারটা ছুঁড়ে দেবেন। ও প্রান্ত থেকে শেখ তবারকের কণ্ঠ ভেসে এল :
-বানু, মা আমি কি জন্য টেলিফোন করেছি সে কথাটি আগে শুনে নাও।
ক্ষুণ্ণকণ্ঠে নুরুন্নাহার বানু বললেন :
-বলুন।
-আগামী শুক্রবার আমার ছোট ছেলের বাচ্চার আকিকার তারিখ । ঐদিন রাত আটটায় তুমি, তোমার মেয়ে এবং জামাই মিয়াসহ আমার বাড়িতে এসে দুটো দানাপানি গ্রহণ করবে। না এলে তোমার বুড়ো চাচার মনে খুব কষ্ট হবে। জামাই মিয়াকে বলতাম, ভাবলাম মেয়ে থাকতে আবার জামাই কেন। মেয়ে ছিল বলেই তো জামাই পেয়েছি। আসবে তো?
-নুরুন্নাহার বানু বললেন :
-চাচা কেমন করে যাব, আপনার বাড়ি তো আমরা কেউ চিনি না। আর আপনার জামাইয়ের নানা মিটিং থাকে। এখানে সেখানে সভা-সমিতিতে যেতে হয়। সময় আছে কি না আমি তো বলতে পারব না।
-বানু, একজন উপাচার্যকে কত ব্যস্ত থাকতে হয়, তা কি আমি জানিনে। কিন্তু আমি ভালো করে খবর নিয়েছি ঐদিন জামাই মিয়া মোটামুটি ফ্রি আছেন। আর আমার বাড়ি চেনার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি লোক পাঠিয়ে নিয়ে আসব।
-দেখি চাচা আপনার জামাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে দেখি।
-জামাইয়ের কাজ থাকে আসবেন না। তুমি আসতে চাও কি না বলো।
-কী যে বলেন চাচা, আমার ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি চলে যাই।
-কোনো ভাবনা নেই বেটি, আজ বুধবার, পরশু শুক্রবার। মাঝখানে বৃহস্পতিবার একটি দিন। পরশু তো তোমাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছেই ।
শেখ তবারক আলীর বাড়িতে আকিকার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবেন কি না একটু দ্বিধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন আবু জুনায়েদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঠিকাদারের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবেন, একথা নিশ্চয়ই জানাজানি হবে। এখানে কোন কথাটি গোপন থাকে? আবু জুনায়েদ মিয়ার অজানা নেই, অবশ্যই পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে। অতীতে ঠিকাদারদের সঙ্গে উপাচার্যের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারি হয়েছে। আবু জুনায়েদ সেসব জানেন না তা নয়। তথাপি তাকে মত দিতে হলো। নুরুন্নাহার বানু জেদ করলেও তিনি রাজি হতেন না। নুরুন্নাহার বানুর প্রভাব খাটাবার কতটুকু অধিকার তার সীমারেখাঁটি আকারে ইঙ্গিতে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আসল কথা হলো শেখ তবারক আলী মানুষটিকে তার পছন্দ হয়েছে। এজন্যেই তিনি যাবেন বলে কথা দিলেন।
শুক্রবার দিন আবু জুনায়েদ, নুরুন্নাহার বানু এবং তাদের কন্যা দীলু সেজেগুজে অপেক্ষা করছিলেন। নুরুন্নাহার বানুর মনে একটুখানি অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল । ইদানীং তার মনে একটা কুসংস্কার জন্মেছে। নির্বিঘ্নে তার কোনো কাজ সমাধা হয় না। কোথা থেকে না কোথা থেকে একটা বাধা এসে হাজির হয়। তার শরীরে অল্প অল্প ঘাম দিচ্ছিল।
ঠিক আটটা বাজতেই খবর দেয়া হলো তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি এসে হাজির। নুরুন্নাহার বানুর মনে অন্যরকম একটা পরিকল্পনা ছিল। উপাঁচর্যের গাড়িটি নিয়ে যেতে পারলে বেশ হতো। তবারক চাচাকে দেখানো যেত, তারা এখন কত বড় গাড়িতে চলাফেরা করেন। নিচে নেমে নুরুন্নাহার বানুর ভিমরি খাওয়ার যোগাড়। বাড়ির সামনে একেবারে চকচকে নতুন একটি পাজেরো গাড়ি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। নুরুন্নাহার বানু ভাবলেন নিশ্চয়ই তবারক চাচার অনেক টাকা হয়েছে। গাড়িটি যে ভদ্রলোক চালিয়ে নিয়ে এসেছেন, তাকেও পেশাদার ড্রাইভার মনে হলো না। উনারা কাছাকাছি আসতেই ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে সালাম দিলেন। দীর্ঘদিন পশ্চিম দেশে থাকলে বাংলা উচ্চারণের মধ্যে যে ধাতবতা পরিলক্ষিত হয়, ভদ্রলোকের কথাবার্তার মধ্যে তেমনি একটি আভাস পাওয়া গেল। এই সুদর্শন তরুণটিকে দেখে নুরুন্নাহার বানুর একটা কৌতূহল জেগে গিয়েছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন :
-আপনি তবারক চাচার কে হন?
ভদ্রলোক একটুখানি ঢোক গিলে বললেন :
-জ্বি উনি আমার শ্বশুর।
নুরুন্নাহার বানু ফের জানতে চাইলেন :