.
০২.
শুরুতে আবু জুনায়েদের দুয়েকটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছি। কিন্তু ও থেকে আবু জুনায়েদ মানুষটি সম্বন্ধে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত গঠন করা সহজ হবে না। পৃথিবীতে নিরীহ মানুষের সংখ্যাই অধিক। এমনকি আমাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতেও তারা এখনো বিরল প্রজাতির প্রাণীতে পরিণত হয়ে যাননি। তত্ত্ব-তালাশ করলে আরো দু-পাঁচজন এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব হবে না। এই নিরীহ মানুষেরা এখনো পর্যন্ত কী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে কোনোরকম বিশেষ ব্যবস্থা ছাড়া টিকে আছেন, সেটা কম আশ্চর্যের ব্যাপার নয়।
আবু জুনায়েদের দৈনন্দিন জীবনের ছকটা চলুন পর্যালোচনা করে দেখি। তিনি খুব সকালে বেলা পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠেই এক চক্কর হেঁটে আসেন। প্রাতভ্রমণ সেরে আসার পর গোসল করতে বাথরুমে ঢুকতেন। মেজাজ ভালো থাকলে কোনো কোনোদিন ফজরের নামাজটা পড়ে ফেলতেন। এমনিতে আবু জুনায়েদ নামাজি বান্দা ছিলেন না। তবে তার একটা ধারণা গজিয়ে গিয়েছিল সকালবেলার নামাজ দিয়ে শুরু করলে সারাটা দিন নির্ঝঞ্ঝাট কাটে। সব দিন এই নামাজ পড়ার নিয়মটা রক্ষা করতে পারতেন না। তাকে নামাজের বিছানায় দেখলে বেগম নুরুন্নাহার বানু বেজায় রকম ক্ষেপে যেতেন। ইদানীং নুরুন্নাহার বানুর মনে একটা সন্দেহের রেখা উঁকিঝুঁকি মারতে আরম্ভ করেছে। আবু জুনায়েদ যে ডিপার্টমেন্টটির শিক্ষক সেখানে বেশ কয়েকজন মহিলা শিক্ষিকা কাজ করেন। তাদের মধ্যে বেশ কজন সুন্দরী। এই সুন্দরীদের একজন আবার অবিবাহিতা। তাকে নিয়ে সব সময় নতুন নতুন গুজব রটতে থাকে। নুরুন্নাহার বানুর মনে একটি চাপা আশঙ্কা আছে। তার স্বামীটি ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। এই রকম দুর্বল শিরদাঁড়াসম্পন্ন মানুষেরাই খুব সহজে ডাকিনিদের খপ্পড়ে পড়ে যায়। নুরুন্নাহার বানুর বয়স বাড়ছিল এবং তলপেটে থলথলে মেদ জমছিল। এটা একটুও অস্বাভাবিক নয়। এরই মধ্যে নুরুন্নাহার বানু বুড়িয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জুনায়েদ দেখতে এখনো তরুণ। মাথার একগাছি চুলেও পাক ধরেনি। নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে সঙ্গে আবু জুনায়েদের শরীরে কেন বার্ধক্য আক্রমণ করছে না, এটাই ছিল নুরুন্নাহার বানুর অসন্তোষের একটা বড় কারণ। নুরুন্নাহার বানু মনে করতে আরম্ভ করছিলেন, আবু জুনায়েদ নিশ্চয়ই অন্য কারো সঙ্গে একটা গোপন সম্পর্ক তৈরি করেছে এবং সেটাই তার সতেজ সজীব থাকার একমাত্র কারণ। নিয়মিত নামাজি না হয়েও যে আবু জুনায়েদ মাঝে-মাঝে ফজরের নামাজ পড়তেন, দেখে নুরুন্নাহার বানু মনে করতেন, তিনি যে তাকে সন্দেহ করছেন ওটা কেমন করে টের পেয়ে গেছেন, তাই কখনো-সখনো নামাজের পাটিতে দাঁড়িয়ে তার কাছে প্রমাণ করতে চাইছেন, দেখো আমি নামাজ পড়ি এবং আমার মনে প্রবল ধর্মবোধ বর্তমান, সুতরাং অন্য স্ত্রীলোকের উপর আমি কোনো আসক্তি পোষণ করতে পারি নে। কিন্তু নুরুন্নাহার বানু মনে করতেন, আবু জুনায়েদ অন্য মেয়ে মানুষের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন সেটা গোপন করার জন্য মাঝে-মাঝে নামাজ পড়ে দেখিয়ে থাকেন। আসলে আবু জুনায়েদের এই লোক দেখানো নামাজ পড়া ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া অনেকদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাস করে নুরুন্নাহার বানুর মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে এখানে মেয়ে পুরুষ মাঠে ছেড়ে দেয়া গরু-মোষের মতো ঘুরে বেড়ায়, তাই যেকোনো সময়ে তারা যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে। সব মেয়েমানুষ কি আর নুরুন্নাহার বানুর মতো!
যা হোক, আবু জুনায়েদ গোসল সারার পর নামাজ পড়ন, না পড়ন, নাস্তা খেতে বসতেন। নাস্তার পর পত্রিকার পাতায় চোখ বুলোতেন এবং সম্পাদকীয়, উপ সম্পাদকীয় কলামগুলো ভালো করে পড়তেন। তারপর ধীরে-সুস্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। এ সময়ে কোনো উপলক্ষ নিয়ে নুরুন্নাহার বানু চটাচটি করলে তিনি মেজাজ খারাপ করতেন না। অ্যাটাচি কেসটা দুলিয়ে ডিপার্টমেন্টের দিকে হাঁটা দিতেন। ডিপার্টমেন্টে তিনি দেড়টা, কখনো কখনো দুটো অবধি কাটাতেন। বিভাগীয় মিটিং বা অন্য কোনো ব্যাপার থাকলে তাকে আরো দেরিতে ফিরতে হতো। আবু জুনায়েদ যেদিন দেরিতে ফিরতেন, নুরুন্নাহার বানুর মেজাজ খিঁচিয়ে থাকত। তিনি মনে করতেন, আজ তার স্বামী সে অবিবাহিতা শিক্ষিকার সঙ্গে লটর-ফটর কোনো একটা কাণ্ড করছেন, নইলে এত দেরি কেন?
ডিপার্টমেন্ট থেকে ফিরে অ্যাটাচি কেসটা টেবিলের উপর রাখতেন, জামা-কাপড় ছাড়তেন। তারপর খেতে বসতেন। যেদিন নুরুন্নাহার বানুর মেজাজ ভালো থাকত পাতে এটা সেটা তুলে দিতেন। পাশে বসে মাছি তাড়াতেন। মেজাজ খারাপ থাকলে রান্নাঘরে থালাবাসন, খুন্তি, হাঁড়ি নিয়ে প্রলয় কাণ্ড বাধিয়ে তুলতেন এবং আবু জুনায়েদের পেয়ারের মাদী বেড়ালটাকে ধরে আচ্ছা করে পেটাতেন। আবু জুনায়েদ ডানে বামে কোনো দিকে না তাকিয়ে খাবার গলাধঃকরণ করে যেতেন। খাওয়ার পর বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাতমুখ ধোয়ার পর শব্দ করে কুলি করে নিতেন। অবশেষে বিছানার উপর শরীরটা ছেড়ে দিয়ে বেলা পাঁচটা অবধি ঘুমোতেন।
পাঁচটার পর ঘুম থেকে উঠে তিনি আবার ডিপার্টমেন্টের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। ছাত্রছাত্রীদের টিউটোরিয়াল খাতা দেখতেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করতেন, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের রিপোর্ট লিখতেন। এসব করতে করতে সন্ধ্যে নেমে আসত। অন্য শিক্ষকেরা এই সময়টিতে ক্লাবে গিয়ে কেউ কেউ টেনিস খেলতেন, কেউ কেউ দাবার সামনে বসে যেতেন। কেউ কেউ গোল হয়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলুদ, ডোরাকাটা, বেগুনি দলের নির্বাচন নিয়ে তর্ক জুড়ে দিতেন। কে কাকে ডিঙিয়ে প্রমোশন পেলেন, কার ছেলেমেয়ে বখে যাচ্ছে, কে আধারাতে বউকে ধরে পেটায়, চাকরাণী মেয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে গিয়ে আচ্ছা নাকাল হয়েছে কে, সরকারি দলে নাম লিখিয়ে কে গুলশানের প্লট বাগিয়ে নিল ইত্যাকার বিষয় ক্লাবে নিত্যদিন আলোচিত হতো। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে কেউ কখনো ক্লাবের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেখেননি। সন্ধ্যাটি যখন গহন হয়ে নামত জুনায়েদ সেই পুরনো ব্যাগটি নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাজারে চলে যেতেন।