-জি আমি বানু, আপনি কে বলছেন?
-আমি তোমার তবারক চাচা, আমার কথা তোমার মনে আছে?
-কী যে বলেন চাচা আপনার কথা মনে থাকবে না? কতদিন পর আপনার গলার আওয়াজ শুনলাম। আনন্দে নুরুন্নাহার বানুর নাচতে ইচ্ছে হলো, দুঃখে কাঁদতে ইচ্ছে হলো।
-হ্যাঁ মা দিন বসে থাকে না। তোমার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল তোমার বিয়ের দিন। প্রায় চব্বিশ পঁচিশ বছর হয়ে গেল ।
-চাচা আপনি কোত্থেকে বলছেন, চলে আসুন আমার আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে করছে।
-শেখ তবারক জবাব দিলেন আমি মতিঝিলে আমার অফিস থেকে বলছি। জামাই মিয়া কি আমার কথা কিছু বলেননি।
-আপনাদের জামাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো কখন?
-বানু আমি তো এখন জামাইর অধীনে কাজ করছি।
-চাচা আপনি কী যে বলেন-
-ঠিকই বলছি বানু, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন কাজ করছি। জামাই আমাকে তোমার বাড়িতে খাওয়ার দাওয়াত করেছিলেন। সব সময় টেনশনের মধ্যে থাকেন, বোধহয় ভুলে গিয়ে থাকবেন । নুরুন্নাহার বানু মনে করলেন, তবারক চাচার কাছে আবু জুনায়েদের হয়ে কিছু সাফাই গাওয়া উচিত। তাই তিনি বললেন :
-ছেড়ে দেন চাচা আপনাদের জামাইর কথা। এরকম ভোলামনের মানুষ দ্বিতীয়টি আমি চোখে দেখিনি। কাজে-কর্মে এত ব্যস্ত থাকেন যে কোনো কোনো সময়ে এক পায়ে মোজা পরে অফিসে চলে যান। থাকুক আপনাদের জামাইর কথা। আপনি এক্ষুনি চলে আসুন। আমি আপনাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াব। এই আমি রান্নাঘরে গেলাম। নুরুন্নাহার মনে করলেন, এই একটা চমৎকার সুযোগ । তবারক চাচা এলে এই বিশাল প্রাসাদের সবগুলো ঘর ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। কত ধরনের চীনামাটির সুন্দর সুন্দর বাসনপত্র, ছুরি, কাঁটাচামচ, ডিনার সেট, কফি সেট সব দেখিয়ে অবাক করে দেবেন। তৈজসপত্র সব দেখানো হয়ে গেলে তিনি তাকে ঘুরিয়ে গোটা বাড়ির কম্পাউন্ড দেখাবেন। সামনের ফুল বাগান, পেছনের তরকারি বাগান, চার পাশের ডালপালা প্রসারিত শিশু গাছের সারি সব দেখলে তবারক চাচার চোখে ধাঁধা লেগে যাবে। পোশাক পরা চাপরাশি, মালি, আয়া, খিদমতগার সব যখন নিজের চোখে দেখবেন, চাচা ঠিকই মনে করবেন নুরুন্নাহারটি রাণীর ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিল।
নিজের সৌভাগ্য এবং ঐশ্বর্যের কথা অপরকে জানাতে এত সুখ, এত আনন্দ এতদিন একথা নুরুন্নাহারের মনে যে উদয় হয়নি একথা ঠিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার্সের শিক্ষকদের স্ত্রীদের নিমন্ত্রণ করার কথা চিন্তা করছিলেন। এ সমস্ত ফুটানিমারা মহিলারা এসে খাবেন এবং খেতে খেতে তাকে উদ্দেশ্য করে বাঁকা তেরছা মন্তব্য করবেন, শুনলে নুরুন্নাহার বানুর মাথায় রক্ত চড়ে যাবে, সে আশঙ্কায় তিনি তাদের খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে পয়সা খরচ করার পরিকল্পনাটি বাতিল করেছেন। তার ভাই এবং ভ্রাতৃবধূদের দেখানোর ইচ্ছেও মাঠে মারা গেছে। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ উপাচার্য হওয়ার পর দুতিনবার তারা আসা-যাওয়া করেছেন। ভাইয়ের বউদের সঙ্গে নুরুন্নাহার বানুর একটা অঘোষিত বিবাদ রয়েছে। ভাই দুজন আব্বাজান এন্তেকাল করার পর ঠিকাদারী করে অঢেল পয়সার মালিক হয়েছেন। তাদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। বউরাও এসেছেন বাড়িঅলা, গাড়িঅলা পরিবার থেকে। মাপা মাইনের সংসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাট বাড়িতে নানা উপলক্ষে যখনই এসেছেন তার সংসারে এটা নেই, ওটা নেই একথা প্রচ্ছন্নভাবে নুরুন্নাহার বানুকে জানিয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘদিন থেকে তিনি ভ্রাতৃবধূদের সূক্ষ্ম খোঁচাগুলো সহ্য করে আসছেন। আবু জুনায়েদ উপাচার্য হওয়ার পর ভাই ভ্রাতৃবধূদের, তাদের ছেলেমেয়েসহ খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে এসেছেন। নুরুন্নাহারের ইচ্ছে ছিল ভ্রাতৃবধূদের সঙ্গে এই বাড়িটির পরিচয় করিয়ে দেবেন। বলবেন ওই রকম বাড়ি সারা বাংলাদেশে এই একটাই আছে। এ ধরনের বাড়িকে গথিক বাড়ি বলা হয়। চীনামাটির বাসন পেয়ালা যেগুলোতে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে এগুলো কেনা হয়েছিল সাহেব উপাচার্যের আমলে। বিলেতের প্রধানমন্ত্রী ডিনার এবং লাঞ্চ খাওয়ার সময় এ ধরনের বাসন পেয়ালা এখনো ব্যবহার করেন।
নুরুন্নাহার বানু তার কথা বলার কোনো সুযোগ করে উঠতে পারলেন না। বড় ভাইয়ের বউ খাওয়ার সময় ভিসিপিতে সদ্য দেখা অমিতাভ বচ্চন এবং মাধুরী দীক্ষিতের একটা ছবি নিয়ে বকবক করতে লাগলেন। নুরুন্নাহার বানু মতলব করেছিলেন খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর পুরুষ মানুষেরা যখন আলাদা হয়ে পড়বেন, পান চিবুতে চিবুতে তার সৌভাগ্য সম্পদের কথা ভ্রাতৃবধূদের সামনে সবিস্তারে তুলে ধরবেন। কিন্তু খাওয়া শেষ হওয়ার পর পান মুখে দেয়ার আগেই ছোট ভাইয়ের আহলাদী বউটি আমেরিকার লসএঞ্জেলস শহরে তার ভাইয়ের মেম বিয়ে করার কাহিনী নিয়ে মেতে উঠলেন। আমেরিকা থেকে বিয়ের যে ভিডিও ছবিটি পাঠিয়েছেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করতে থাকলেন। ভায়ের গাড়ি, ভায়ের বাড়ি, কুকুর, বাগান, বউয়ের শুভ বিয়ের গাউন, নীল সুন্দর আয়ত নয়ন এবং লসএঞ্জেলস শহরের আকাশ ঠেকা অট্টালিকার সারি, বিরাট বিরাট গাড়ির মিছিল, শীতের তুষারপাত এসবের এমন জমকালো বর্ণনা দিতে থাকলেন, স্বয়ং নুরুন্নাহার বানুও মুগ্ধ হয়ে কাহিনীটা না শুনে পারলেন না। তারপরেও একটা ক্ষীণ আশা ছিল, শান শওকতের কথা না হোক অন্তত এই বাড়ির একটা ঐতিহ্য আছে সেটা বুঝিয়ে দেবেন। বিয়ের গল্প শেষ হওয়ার পর বড় ভাইয়ের বোনের মেয়েটি মা এবং চাচির সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়ে বসল। বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য এমন চিৎকার এবং কান্না জুড়ে দিল যে ভাই এবং ভ্রাতৃবধূরা বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। নুরুন্নাহার বানু ভাই, ভ্রাতৃবধূদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। তাদের গাড়ি রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেলে তিনি অনুভব করলেন, ভ্রাতৃবধূরা তাকে একটা মস্তরকম দাগা দিয়ে গেলেন।