একদিন রাত নটার দিকে শেখ তবারক আলী মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে টেলিফোন করলেন। ধরেছিলেন নুরুন্নাহার বানু। হ্যালো কে বলতেই ও প্রান্ত থেকে দরদী মোলায়েম কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো ।
-কে বানু?
নুরুন্নাহার বানু একটু চমকালেন। আব্বা মারা যাওয়ার পর তাকে এ নামে সম্বোধন করার কোনো মানুষ এ দুনিয়াতে আছে তিনি জানতেন না। আম্মা তাকে বানু টানু বলেন না। সরাসরি নুরুন্নাহার বলেই ডাকেন। ইদানীং টেলিফোনে তার বিরক্ত বিরক্ত কর্তৃত্বব্যঞ্জক কণ্ঠস্বর প্রকাশ করে এক ধরনের গোপন আনন্দ অনুভব করতেন। একটু রাগত স্বর, একটু বিরক্তি, একটু কর্তৃত্বের ভাব না দেখালে মানুষ তাকে আলাদা করে চিনে নেবে কীভাবে। নুরুন্নাহার বানুর ধারণা উপাচার্যের স্ত্রীদের কণ্ঠস্বরে একটু উত্তাপ একটু আঁজ থাকা ভালো। আবু জুনায়েদ টেলিফোনের রিসিভার কানে লাগিয়ে যেভাবে বিনয়ে বিগলিত হয়ে মিনি-মিনি করে কথা বলেন, দেখলে নুরুন্নাহার বানুর পিত্তি জ্বলে যাওয়ার উপক্রম হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী সব মিলিয়ে তিরিশ পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষের নায়ক এবং চালক হলেন মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ। নুরুন্নাহার বানু মনে করেন, তুমি যদি একটু ধমকধামক দিতে না পার, একটু রাগ একটু হুংকার না দিতে পার, তাহলে উপাচার্য হওয়ার মজা কোথায়, নুরুন্নাহার বানু বালিকা বয়সে থানার একজন সামান্য দারোগাকেও বাঘের মতো হুংকার ছাড়তে দেখেছেন। আবু জুনায়েদ এত বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর মানুষ, অথচ তার কণ্ঠে রাগ ঝাল নেই।
আবু জুনায়েদের স্থলে নুরুন্নাহার বানু যদি দায়িত্বভার গ্রহণ করতেন, তাহলে প্রথম চোটেই তিনি যে সকল মেয়ে ঘরে ঢুকে তাকে অপমান করে গেছে তাদের খোঁপার চুল কেটে কপালে লোহা পুড়িয়ে সারা জীবন অক্ষয় থাকে এমন দাগ বসিয়ে দেয়ার হুকুম দিতেন। খারাপ মানুষদের কপালে একটা স্থায়ী দাগ থাকা উচিত। নুরুন্নাহার বানু মনে করেন, যে সকল মেয়ে তার বাড়িতে চড়াও হয়েছিল, বাথরুমের কমোড, জানালার কাঁচ এবং ডাইনিং হলের বেসিন চুরমার করেছে আর নুরুন্নাহার বানুকে বিবস্ত্র করে ফেলেছিলেন, তাদের বেশিরভাগই নষ্টা এবং খারাপ মেয়ে মানুষ। নষ্টা না হলে কি কেউ আচমকা এসে এমন জঘন্য কাণ্ড করতে পারে । এভাবে চিন্তা করলে নুরুন্নাহার শাস্তিযোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা অনেক দীর্ঘ হয়ে দাঁড়ায়। তার মধ্যে প্রথমে আসবেন তাদের পাশের ফ্ল্যাটে যে ফাত্তাহ সাহেব থাকতেন তার স্ত্রী রহিমা খাতুন। রহিমা খাতুনের ছাগল একাধিকবার তার তরকারী বাগান খেয়ে ছারখার করেছে। নালিশ করলে জবাবে রহিমা খাতুন সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছিলেন নুরুন্নাহারের বাগান ভক্ষণ করার জন্যেই রহিমা খাতুন ছাগল পুষেছেন। সে অবধি নুরুন্নাহার বানু রহিমা খাতুনের প্রতি ভেতরে একটা গনগনে রাগ পুষে রেখেছেন। তারপরে আসে উপরতলার সালমা বেগম। সালমা বেগমের পোষা মুরগি একবার ঘরে ঢুকে নুরুন্নাহার বানুর কালোজিরে চাল সবটা খেয়ে ফেলেছিল। নুরুন্নাহার বানু যদি চাল ডাল এসব মুরগির নাগালের বাইরে রাখেন। তাহলে কষ্ট করে পুনরায় তাকে নালিশ করতে আসতে হবে না। এই বাঁজা মহিলাটির এমন জবাব শুনে নুরুন্নাহার বানুর ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে উঠেছিল, কিন্তু বাদানুবাদ করেননি। ঠিক করেছিলেন সুযোগ পেলে আস্ত মুরগিটাই জবাই করে হালাল করবেন। সেই পুণ্য কর্মটি সমাধা না করেই তাকে উপাচার্য ভবনে চলে আসতে হয়েছে।
নুরুন্নাহার বানুর সবচেয়ে বেশি আক্রোশ আবু আবদুল্লাহর মাকাল চেহারার ঢ্যাঙা ছেলেটির উপর। একদিন চারদিক থেকে অন্ধকার কেঁপে এসেছে। সেই কার্তিকের মিহি হিমের সন্ধ্যেয় দেখেছেন তার আদরের মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে আবু আবদুল্লাহর মাকাল ছেলেটা চুমু খাচ্ছে। আর মেয়েটি বাঁশের কঞ্চির মতো এঁকে বেঁকে যাচ্ছে। এই সংবাদটি তিনি আবু জুনায়েদের কাছেও প্রকাশ করতে পারেননি। কেবল মেয়েটিকে চুল ধরে টেনে এনে মারতে মারতে আধমরা করে ছেড়েছিলেন। আবু আবদুল্লাহর মাকাল ছেলেটিকে তার ফাঁসিতে লটকাবার ইচ্ছে হয়েছিল। সে আকাঙ্ক্ষাটিও এখনো মরেনি। এরকম ছোট বড় অনেক খেদ অনেক ক্ষোভ তার মনে ফোস্কা ফেলতে থাকে। তার স্বামীরত্নটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু তাকে দিয়ে নুরুন্নাহার বানুর কোন কাজটি হয়েছে, কোন শখটি পূরণ হয়েছে? নুরুন্নাহার বানু মনে করেন, একেবারে চালচুলোহীন পরিবারের সন্তান বলেই তার স্বামীটির এমন মেন্দামারা স্বভাব । স্বামীটি ওরকমই থেকে যাবে। নুরুন্নাহার বানুকে মনের জ্বালা, মনের ভেতর পুষে যেতে হবে। টেলিফোনে তার কণ্ঠস্বরে ঝাঁজ এবং বিরক্তি প্রকাশ হয়ে পড়ে, কারণ তার অবদমিত দুঃখ যন্ত্রণাগুলো প্রাণ পেয়ে উঠতে চায়।
শেখ তবারক আলীর বানু সম্বোধন শুনতে পেয়ে নুরুন্নাহার বানুর সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে ঢেউ খেলে গেল। একটি আওয়াজ শোনামাত্রই তার শৈশব, তার কৈশোর দৃষ্টির সামনে মূর্তিমান হয়ে উঠল। শরীর ভেদ করে প্রথম রক্তপাতের ঘটনাটি তার মনে পড়ে গেল। বানু, বানু, কে ডাকে, কে ডাকে? সেই ভাবাবেশমাখা কণ্ঠেই জবাব দিলেন :