সেদিন থেকে স্ত্রীর প্রতি আমার মনোভাবটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। বুঝতে বাকি থাকল না, তার মনের ভেতর কথা বলার আকাঙ্ক্ষা কি রকম জলপ্রপাতের ধারার মতো ফুলে ফুলে উঠছে। তার কণ্ঠও সুন্দর ধ্বনির প্রসূতি হতে তীক্ষ্মভাবে আগ্রহী। একজন মানুষ কথা বলতে পারে না, এটা কত দুঃখের!
যেটা আমাকে সবচে বেশি নাড়া দিয়েছে আমার স্ত্রী বাকশক্তিহীন দশাটিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়নি। তার শরীরের প্রতিটি কণা, প্রতিটি অণু-পরমাণু এই বোবাত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিক্ষোভে ফেটে পড়তে চায়। আমি নিজের চোখে তো দেখলাম। তারও মনের গভীরে ফুলের স্তবকের মতো কথা স্তরে স্তরে সাজানো রয়েছে। তার মনের ভেতর সুখ-দুঃখের আকারে যা ঘটছে এবং বাইরের পৃথিবীতে সুন্দর কুৎসিত যা বিরাজমান রয়েছে, প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে- সব কিছুরই একটি নাম আছে। এই নামটিকেই সে প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু পারে না। বাক যন্ত্রটি খারাপ এবং অকেজো বলে।
এই কদিন আগে আমিও তো মনের খনিজ তিমিরে মধুর গুঞ্জরণশীল পাখনাযুক্ত শব্দ ভাণ্ডার পরম দুঃখে আবিষ্কার করেছি। শুধু মেয়েমানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য কেমন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমার বৌটির অবস্থা তার চাইতে ঢের ঢের করুণ। তার আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি গভীর। দাবী অনেক বেশি বাস্তব এবং জোরালো। স্ত্রীর প্রতি দরদ এবং মমতায় সমস্ত অন্তর মথিত হয়ে উঠল। সে রাতে তাকে অত্যন্ত কোমলভাবে আদর করলাম। স্বামী হিসেবে জীবনে যে-সব করিনি সব করলাম। হঠাৎ আদরের ঘটা দেখে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল । স্ত্রী জীবনে কোনোদিন আদর মমতার মুখ দেখেনি। খুবই ছোট্ট বয়সে মাকে হারিয়েছে। সত্মার সংসারে মানুষ। আমি তো একজন নিষ্ক্রিয় পুরুষ। হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তার বাইরে কিছু আছে বা থাকতে পারে একথা মনে একবারও উদয় হয়নি। আসলে আমার শ্বশুর সাহেব মোক্তারী বুদ্ধি দিয়ে যা সম্ভাবিত করেছিলেন তাই নিয়েই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম।
গুণী বাজিয়ের হাতে পড়লে বেহালার তারের তড়িত যেমন অপরূপ শিখায় জ্বলে ওঠে তেমনি তার সমগ্র সত্তা আমার প্রতি স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। চোখে ঘুম নামছিল। আধোঘুমের মধ্যে অনুভব করলাম আমার বৌটি কাঁদছে… আহা কাঁদুক।
মাঝরাতে উঠে বাথরুমে যাবার জন্য বাতি জ্বাললে দেখি সে একাকী জানলার পাশে হাতের ওপর মুখ রেখে বসে রয়েছে। খুব দূরে শিরিশ পাতার জালের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে একখণ্ড কৃষ্ণ পক্ষের স্নান চাঁদ উঠে আসছে। তার মুখমণ্ডলে দেবীর মতো বিকশিত মহিমা। হাত ধরলে পায়ে পায়ে বিছানায় চলে এল। সারারাত একতাল কাঁদার মতো আমার শরীরের সঙ্গে লেগে রইল।
৬. শরীর খারাপের নাম
০৬.
দুচারদিন পর শরীর খারাপের নাম করে একটানা দুই মাসের ছুটির দরখাস্ত দিলাম। আমাকে ছুটি নিতে দেখে অফিসের সমস্ত মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। চোখের ওপর দিয়ে প্রতি বছর শীত বসন্ত গড়িয়ে গেছে, গ্রীষ্ম বর্ষা অতীত হয়েছে। শরৎ হেমন্তে দেখেছি কখনো বা অফিসের নুলো পিয়নটিও যথারীতি ছুটি ভোগ করে অপরিমিত প্রাণোচ্ছ্বাস নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। আমার যে কি করে চলত, কি করে যে আমি এই ছোট্ট অফিস কামরার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতাম, তা বলতে পারব না।
সে যাক দুমাসের ছুটি নিলাম। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক একরকম চুকিয়ে দিয়ে বাসায় এসে ডেরা পাতলাম। এ দুটি মাসই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। সকাল সন্ধ্যে ঘরে থাকি। খুঁটিনাটি কাজে মন দেই। আমরা স্বামী-স্ত্রী বিয়ে হওয়ার বহু বছর পর আবার নব বিবাহিত দম্পতির মতো জীবন শুরু করলাম। প্রতিটি দিনকেই যেন আমরা দুজনে অস্তিত্বের ভেতর থেকেই সৃষ্টি করে নিচ্ছিলাম। প্রতিটি উষা রাঙা নিমন্ত্রণলিপি মেলে ধরে। দিনগুলো ঝকঝকে নতুন প্রাণবন্ত। অফুরন্ত স্বাদ-গন্ধে সারা মন প্রাণ ভরিয়ে দিয়ে যায়। রাতগুলো বিধাতার আশীর্বাদের মতো সন্ধ্যের স্বর্ণতেরণ দিয়ে কেমন কান্তিমান ভঙ্গিতে নেমে আসে।
আমি আজকাল ফুর্তিবাজ হয়ে উঠেছি। স্ত্রীটিও বেশ সুন্দরী হয়ে উঠেছে। জীবনের জল তার সারা শরীরে ঝলকাতে লেগেছে।
অঙ্গে লাবণ্যের স্রোত নতুন গাঙের মতো ঢলঢল করে। আজকাল সাজ পোশাকের দিকে তার নজর বহুগুণে বেড়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে । মাথা ভর্তি কালো চুল ছেড়ে দিলে পিঠ ঝেপে যায়। ইচ্ছে হলে গোল করে খোঁপা বাঁধে। ইদানীং দুয়েকটা ফুল খুঁজতেও শিখেছে। মৌসুমী ফুলের চারা লাগিয়েছি কটি। পরনের শাড়ি শক্ত করে কোমরে পেঁচিয়ে সকাল দুপুর জল ঢালে। তরু শিশুদের পুত্র-কন্যার স্নেহে লালন করে তখন তাকে ঠিক আশ্রম কন্যার মতো মনে হয়। সমস্ত শরীরে সরল সৌন্দর্য ফুলের গর্বে ফুটে থাকে।
বোনের গানের রেয়াজ করার সময়টিতে ইচ্ছে করে আমি ঘরে থাকিনে। স্ত্রী স্বরগ্রাম অনুকরণ করার প্রয়াসটি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি। হাত-পায়ের খিল ধরা অবস্থাটিকে এখন আকার পাওয়া সুন্দর সুমিত একটি পিপাসার মতো লাগে। এমনি করেই বুঝি প্রাচীনকালে সাধনাকে অপ্সরারা মুণি ঋষির ধ্যান ভাঙাতো। তার এই নীরব একমুখী সাধনাকে মনে মনে প্রকৃতির হলাদিনী শক্তির সঙ্গে তুলনা করে কৌতুক বোধ করতাম। আমার বোনের গানের চেয়ে মধুর, পৃথিবীর সেরা নর্তকীর নাচের মুদ্রার চাইতে দৃষ্টিহারী অনুপম তুলনাবিহীন। বোধহয় এই সুন্দরের সাধনার বলেই দিনে দিনে সে সুন্দরী হয়ে উঠছে। আমার চোখে তার বোবাত্ব ঘুচে গেছে । প্রতিটি ভঙ্গিই এখন আমার মনে শ্রেষ্ঠ কবিতার আমেজ জাগিয়ে তোলে। তার এই প্রচেষ্টা ফাল্গুনের ফুল ফোঁটাবার জন্য শীতে সাধনার মতো গোপন এবং কঠিন। যখন-তখন তাকে আমি চুমো খাই। তার মুখমণ্ডলে একটা অসহায় ভাব জলছবির মতো আপনাআপনি ভেসে উঠে- দেখলে মনের ভেতর কি যে দুঃখস্রোত বয়ে যায়। মানুষ কেন বোবা হয়ে জন্মায়? বোবারও বা কথা বলার অত সাধ জাগে কেন?