মা-মরা মেয়েটির এই নিঃসঙ্গ জীবনযাত্রা দেখে কতবার আমার মনটা হু হু করে নিঃশব্দে কেঁদেছে। অনেকবার ভেবেছি তাকে একটু আদর করব, মাথায় হাত বুলিয়ে দেব, একটা সুন্দর জামা, দুগজ চুলের ফিতা কিনে দেব। একদিন সিনেমায় নিয়ে যাব। কিন্তু অনভ্যেশবশত এসবের কিছুই করতে পারিনে। তাই বোনটি যেমন আছে তেমনি রয়েছে। চোখের কোণায়, মুখাবয়বে ভয় পাওয়ার সে প্রাচীন গ্রামীণ চিহ্নটি এখনো অক্ষয় হয়ে জেগে আছে।
মানস যন্ত্রণার এই সময়ে আমি বড় অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। ধারে কাছে কেউ নেই যে একটু গভীর কথা বলে বুকের ব্যথা লাঘব করি। ব্যথা মনে পাষাণের মতো চেপে থাকে। কি করি, কোথায় যাই। কার কাছে গিয়ে মনের এই অদ্ভুত বেদনার কথা প্রকাশ করি। মনের ভেতর যে ক্ষিপ্র স্রোতোবেগ জাগছে কোথায় আছে এমন পরম বান্ধব যার কাছে গিয়ে সব অকপটে প্রকাশ করি। এই পৃথিবীতে আমার তো আপনার জন বলতে কেউ নেই।
এই সময়ে ছোট বোনটির সঙ্গে একটু একটু করে কথা কইতে থাকি। পয়লা তো সে আমার কাছেই ঘেঁষত না। একটা কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেবার সময় পাঁচবার তোতলাতো। তিনবার মুখের দিকে করুণভাবে তাকাতো। মনে মনে আশা করতাম বোনটি এইবার কথা বলুক। ভাইজান বলে ডাকুক। অসীম উৎকণ্ঠায় প্রতিদিন প্রতীক্ষা করি। কিন্তু বোনের কণ্ঠে সে আকাঙ্ক্ষিত ধ্বনিটি শুনিনে। অনাদরে অবহেলায় তার মধ্যে যে নির্বাকতার সৃষ্টি করেছি, কিছুতেই সে দেয়াল ভাঙল না। অগত্যা নিজেই উদ্যোগী হয়ে তার সঙ্গে এটা সেটা নানা কথা কইতে থাকি। এই কথাবার্তার প্রভাবেই আমি অনুভব করলাম আমার মানসিক স্থিতিশীলতা ফিরে। আসছে।
এভাবে কিছুদিন যাবার পর আমরা অত্যন্ত সহজভাবে পরস্পরের সঙ্গে কথা কইতে থাকি। তারপর থেকে আমরা দুভাইবোনে কথা বলতাম। গ্রামের বাড়ির কথা, বাবা-মার কথা, অদ্ভুতকর্মা পূর্বপুরুষদের কথা। আমাদের পরিবারের ঘুমন্ত ইতিহাস ভাইবোনের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে চমকে চমকে জেগে উঠত। অবলীলায় কথা বলতে শুরু করার পর থেকে আমি উপলব্ধি করি যে আগের সে ভীত-সন্ত্রস্ত ভাবটি কেটে গেছে। মানসিক অভাববোধ আমাকে আর ক্ষ্যাপার মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় না। একদিন এক বন্ধুর বৌয়ের গলায় গান শুনে চট করে ধারণা করে ফেললাম বৌটিকে গান শেখাব। তাকে দিয়ে নিপ্রাণ জড় এবং শুষ্ক শব্দ সমষ্টিতে প্রাণের গতি দান করব। এলোমেলো ধ্বনিপুঞ্জ ধরে সুন্দর সুর সৃষ্টি করার সুকুমার কলা কৌশল শেখাব। এটা আমার বোবা মেয়ে বিয়ে করার প্রতিক্রিয়া কি না বলতে পারব না। অনেক খোঁজ-খবর করার পর ভাল এবং বুড়ো দেখে একজন গানের মাস্টার ঠিক করে দিলাম।
৫. মানসিকতার শেকড়
এখন আমার মানসিকতার শেকড়ে শেকড়ে নতুন রসের রসায়নের লীলাখেলা চলছে। তার কার্যকারণসূত্রের সমস্ত রহস্যটা আমার কাছেও সুস্পষ্ট নয়। তবু বলি, বোনটি গান-বাজনায় বেশ সুন্দর উন্নতি করছে। এটা যে কেমন করে সম্ভব হলো তা আমি নিজেও বলতে পারব না। আমাদের পরিবারে কোনোকালে গান-বাজনার চর্চা ছিল না। হয়তো এমন হবে আমার বাবার রক্তের যে বাসনা, যে কামনা পাথরের ভেতর কীটের মতো বন্দী হয়ে ছিল, তাই-ই আমার বোনের কণ্ঠস্বরে রঙিন কুয়াশার মতো মুক্তিলাভ করছে। আমি যে কত খুশী হয়েছিলাম।
যাক আসল কথায় আসি। এই সময় থেকেই স্ত্রীকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে দেখতে আরম্ভ করলাম। একটা ছোট্ট ঘটনাই তার কারণ। তাই সেটা বিবৃত করি। একদিন সন্ধ্যেবেলা আমি অফিস থেকে ফিরেছি। কি কারণে মনে পড়ছে না, সেদিন ফিরতে একটু দেরী করে ফেলেছিলাম। আমি তো বোবা স্ত্রীর স্বামী। তাই অফিস থেকে ফিরে অযথা কাউকে ডাকাডাকি করে বিড়ম্বনা বাড়াইনে। সেদিনও চুপি চুপি গেট খুলে ঘরে ঢুকি। আমার বোন তার থাকার ঘরটিতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের প্র্যাকটিস করছে। গলার স্বর উঁচু পর্দা থেকে নিচু পর্দায় নামছে। নিচু থেকে উঁচুতে চড়ছে। স্বরতরঙ্গের এই লাস্যময় উত্তরণ অবতরণ ধারায় প্রাণের যে মাধুরী রক্ত সন্ধ্যেয় ব্যক্ত হচ্ছে তা ঘরের বাতাস পর্যন্ত মধুময় করে তুলেছে। আমার বোন নিজের মনে গান-বাজনা করছে। আর আমার বোবা স্ত্রী বদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তার গলা দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ নামছে। বাতির আলোতে একফালি কপাল দেখতে পাচ্ছি। দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো সুন্দর। চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়ছে। সারা শরীর থর-থর করে কাঁপছে। কোনো অসুখ-বিসুখ নয়ত! হাতে পায়ে বিশ্রী রকম খিল ধরার অবস্থা। সচরাচর সে তো এমন করে না। কাউকে ডেকে রহস্যটা উদ্ঘাটন করার সংকল্প নেই। বেশ খানিকক্ষণ লাগল বুঝতে।
আমার বোন গান গাইছে আর বোবা স্ত্রী সকলের অলক্ষ্যে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় বোনের সুরেলা কণ্ঠের সঙ্গে নিজের নির্বাক কণ্ঠটি মেলাবার চেষ্টা করছে। চমৎকার অনুসরণ প্রক্রিয়া। কিন্তু পারছে না। সে তো বোবা। তার বাক-যন্ত্রটি কাজ করছে না। কিন্তু শরীরের অণুপরমাণু এই অক্ষমতা মেনে নিতে রাজী নয়। তাতে করে হিষ্টিরিয়া রোগীর মতো খিল ধরছে। সমস্ত শরীর থেকে যে প্রচণ্ড প্রয়াস স্কুরিত হচ্ছে তারই তোড়ে গলা দিয়ে গোল গোল নুড়ি পাথরের খণ্ড-খণ্ড শব্দাংশ ঝরে পড়ছে। সেটা ভাষা নয়। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার পূর্বে যে ধরনের আওয়াজ দেয় তেমনি ধরনের একটা কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় ।