আমার বি. এ পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। এমন সময়ে চূড়ান্ত দুঃসংবাদ শুনলাম। বাবা হাইকোর্টের মামলায় গরু হারা হেরেছেন। আবুনসর মোক্তার সাহেব মামলার খরচ ডিগ্রি পেয়েছেন। যেহেতু আমাদের ঋণ পরিশোধ করার মতো টাকা নেই, তাই মোক্তার সাহেব আদালতে জীর্ণ বাড়ি, হাজা পুকুর, জমা দিঘি সব নিজের নামে নিলাম করিয়ে নিয়েছেন। খবর শুনে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। পাগলের মতো ছুটে বাড়ি এলাম। গাঁয়ের মানুষ নানারকমের গুজব ছড়াচ্ছিল। কেউ বলছিল পুলিশ এনে আমাদের বাড়ির বের করে দেয়া হবে, কেউ বলছিল আমাদের জীর্ণ বাড়ি ভেঙে বেগুন চাষ করে মোক্তার সাহেব গায়ের ঝাল মেটাবেন। আমি, আমি কি করব। অসুস্থ জনক, বৃদ্ধা জননী এবং ছোট বোনটার হাত ধরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। চিন্তা-ভাবনা করার শক্তি বিলকুল হারিয়ে ফেলেছিলাম। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ সমবেদনার কথা বলতে আসত। তখন, ঠিক তখনই আমার চোখ ফেটে ঝরঝর করে জল বেরিয়ে আসতে চাইত।
এ অকূলেও কূল পেয়ে গেলাম। পথ বাৎলে দিলেন স্বয়ং আবুনসর মোক্তার সাহেব। বাবার এই সাংঘাতিক অসুখের সময় তিনি এক সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে এলেন। আগের দিনে এলে যেমন করতেন, তেমনি অত্যন্ত প্রসন্নভঙ্গিতে কথাবার্তা কইলেন। আগে কেন তাঁকে খবর দেয়া হয়নি সেজন্য মৃদু স্বরে আমাদের বকলেন। বাবার কপালে হাত দিয়ে তাপ পরীক্ষা করলেন। চুক-চুক আফসোস করলেন। কথাবার্তার ভঙ্গিটি এরকম যেন কোনোদিন তার সঙ্গে আমাদের টু শব্দটি হয়নি। মনে হল, মার সঙ্গে তিনি আগের চাইতেও সমীহ করে কথাবার্তা বলছেন। তাঁর আগমন আমাদের বাড়িতে এতই অভাবিত যে আমরা পান তামাকটা দেয়ার কথাও ভুলে গেছি। এরই মধ্যে অর্থস্বার্থ বুদ্ধি পরামর্শের জোরে মোক্তার সাহেব একজন দেশের কেউকাটা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যে এমনভাবে আমাদের বাড়িতে আসতে পারেন, স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। অনেকক্ষণ বসে নানা সুখ-দুঃখের কথা কইলেন।
যাওয়ার সময় মাকে উঠোনে ডেকে নিলেন। নারকেল গাছের হেলানো ছায়াটির নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চুপি চুপি কি সব কথাবার্তা কইলেন। তারপর গমিত হলেন। সন্ধ্যেটা গাঢ় হয়ে এসেছে। আমাদের জীর্ণ বাড়িতে ঝিঁঝির চিৎকার ঘনায়মান অন্ধকারকে আরো ভুতুড়ে করে তুলেছে। মা ঘরে এসে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। মোক্তার সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে চুপি চুপি কি বলে গেলেন আমি জানতে চাইলাম না। মা তেমনি চুপ করেই রইল। ফের জিজ্ঞেস করলাম, কি বলে গেল? মা দুবার ঢোক গিলল। একবার আমার দিকে, একবার রুগ্ণ বাবার দিকে বড় করুণভাবে তাকালো। বুঝতে অসুবিধা হলো না, কথাটা বলতে মার কেমন জানি কষ্ট হচ্ছে। যাহোক কথাটা বাবার গায়ের ওপর ভালো করে টেনে দিয়ে আস্তে আস্তে মা বলল : আমাদের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না, পুকুর দিঘি সব আগের মতো আমাদের দখলে থাকবে। মোক্তার সাহেব নিজ ব্যয়েই বাড়িঘরের সংস্কার করিয়ে দেবেন। বাবাকে শহরে রেখে বিলেতফেরত ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাবেন। এটুকু বলে একটু থেমে মা বাবার মুখমণ্ডল আরেকবার ভালো করে দেখে নিল। আসল কথাটা বলবে কি না তখনো দ্বিধা করছিল।
কথাটা বাবা শীর্ণ হাতে মুখ থেকে সরিয়ে ক্ষীণ কিন্তু তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলল : তারপর… তারপর কি বলল? এইবার মা বলে ফেলল। বিনিময়ে আমাকে শুধু তার বোবা মেয়েটিকে বিয়ে করতে হবে। বাবা একটিমাত্র ধ্বনি উচ্চারণ করলেন : কি? কেরোসিনের বাতিতে ঐ স্বল্পালোকিত ঘরে ঐ ছোট্ট ধ্বনিটি অনেকক্ষণ পর্যন্ত যেন জ্বলতে থাকল। মা আর আমি পাশাপাশি বসে। বাবার মুখ দিয়ে সেই ছুঁছুঁলো ধ্বনিটি আবার তীরের মতো বেরিয়ে এল কি? তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে পাশ ফিরে ঘুমালেন। তার বুকের গভীরে ফোঁসকা পড়ছে আর ভাঙছে।
মা কোনো বিষয়ে কোনোদিন মতামত দেয়নি। বাবা নিঃসাড়। সব জেনে সব বুঝেও হ্যাঁ বললাম আমি। কেন রাজী হয়ে গেলাম বলতে পারব না। লোভের বশীভূত করার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে। অতএব শ্রাবণ মাসের এক গুমোট দিনে আবুনসর মোক্তার সাহেবের বোবা মেয়েটির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বাবার অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হয়ে আসছিল। মা কেমন ঝিম মেরে গেল। মোক্তার সাহেব কথামতো বাবাকে হাসপাতালে রাখলেন। বড় ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তার দেখলেন এবং ঘাড় ফেরালেন। তিনি হাসপাতালেই মারা গেলেন। বাবার পেছনে পেছনে গেলেন মা।
৪. আবুনসর মোক্তার সাহেব
আবুনসর মোক্তার সাহেব আমাকে শুধু মেয়ে দিলেন না। হতাশা লাঞ্ছিত পূর্বপুরুষের জীর্ণ অট্টালিকা থেকে টেনে আলো-ঝলমল-করা শহরে এনে বসালেন। রাজধানী শহরে আমার চাকরি হলো। চাকরির সঙ্গে সঙ্গে আস্ত একখানা বাড়িও শ্বশুর সাহেব মোক্তারী বুদ্ধি খরচ করে জুটিয়ে দিলেন। আগে থাকত এক নিরীহ ব্রাহ্মণ। যে প্যাঁচে শ্বশুর সাহেব তার বেয়াইকে অন্তত দশ বছর আগে স্বর্গে পাঠিয়েছিলেন একই প্যাঁচে নিরীহ ব্রাহ্মণকে গ্রাম এবং শহরের সমস্ত মূল থেকে উপড়ে তুলে সীমান্তের ওধারে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
মোক্তার সাহেবকে এখন থেকে শ্বশুরই বলব। শুরু থেকে কেন সম্মানসূচক বাক্য ব্যবহার করে আসছি, আশা করি এখন তা বুঝতে পারছেন।
দেশে ত্বরিত গতিতে সময় পাল্টাচ্ছিল। পৃথিবীর গভীর গভীরতরো অসুখের খবর সংবাদপত্রের পাতায় কালো ফুলের মতো ফুটে থাকে। দেশে আইয়ুব খান সাহেব সৈন্য-সামন্ত নিয়ে গেড়ে বসেছেন। সংবাদপত্রের ব্যানারে খান সাহেবের একজোড়া গোঁফ হুংকার দিয়ে জেগে থাকে। দেখতে না দেখতেই দেশের জীবন প্রবাহের মধ্যে খান সাহেবের অপ্রতিহত প্রভাব প্রবল সামুদ্রিক তিমির মতো ছুটাছুটি করছিল। এই সুযোগে আমার শ্বশুরের মতো মানুষেরা অন্ধকার থেকে সূর্যালোক ফাঁকি দিয়ে শহরের ফ্ল্যাশ ক্যামেরার সামনে উঠে আসতে লেগেছেন। আগেই তিনি মোক্তারী ছেড়ে দিয়েছিলেন। মরা গরুর খালের নাহান আদালতের ময়লা বেটপ শামলা গা থেকে গাছের পুরনো বাকলের মতো ঝরে পড়েছে সে কবে। এখন তিনি আদ্দির গিলে করা ফিনফিনে পাঞ্জাবী পরেন। সোনার বোতাম ঝিলিক দেয়। হাতে হীরার আংটি ঝকমক করে। তিনি আইয়ুব রাজত্বের শক্ত একটা খুটি না হলেও ঠেকনা জাতীয় কিছু একটা তো বটেই। বসনে-ভূষণে অনেক সম্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছেন। একটা ব্যক্তিত্বও না জানি কোত্থেকে উড়ে এসে শরীরে আশ্রয় করেছে। একটু বয়স হলে যেমন মেয়েদের বুকে স্তনের বাঁকা রেখা আভাসিত হয়, তেমন টাকা পয়সা এবং দাপট এলেই শেয়ালের মতো চেহারায়ও সিংহের আকৃতি জাগি জাগি করে।