আড়াই হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে বাবার মাথা ভয়ংকর বিগড়ে গিয়েছিল । গ্রামে আমাদের খুবই অখ্যাতি রটেছিল। বাবা দশজনের সামনে মুখ দেখাতে পারছিলেন না। হাটে বাজারে যাওয়া-আসা করাও তাঁর পক্ষে একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তিনি আমাদের দহলিজে বসে দিনরাত চাপা রাগে ফুলতে লাগলেন। অপমানে হতাশায় অন্ধ হয়ে এককালীন হিতৈষী সুহৃদ আবুনসর মোক্তার সাহেবের সঙ্গে এক ধারা দুধারা থেকে শুরু করে আইনের সর্বোচ্চ নম্বরে মামলা জুড়ে দিলেন।
আবুনসর মোক্তার সাহেব এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে জটিল প্যাঁচ কষে দুনিয়ার আমাদের অংশ নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসছিলেন, সে একই সূক্ষ্ম প্যাঁচ অতীতজীবী উদভ্রান্ত বাসনার অসহায় শিকার আমার বাবার ওপর ঠাণ্ডা মাথায় অথচ পরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে প্রয়োগ করে রক্তের গাঁজলা বের করে দিচ্ছিলেন। মামলায় আমাদের হার হচ্ছিল। বাবা যতই হারছিলেন ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। এক সময়ে অবশ্য তাঁর বুঝতে বাকি রইল না, কানা মোক্তার তাঁকে সম্পূর্ণ ধরাশায়ী না করে ছাড়বেন না।
৩. সেই সময়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার
সেই সময়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার পূর্বপাকিস্তানের ক্ষমতায় আসে। তারা জমিদারী প্রথা উঠিয়ে দিল এবং জমিদারীর পেছন পেছন তালুকদারী প্রথা আপনা থেকেই উঠে গেল। বাবা খবরটা কাগজে পড়ে প্রথম দুতিন দিন- যে ভিখিরীর ছেলেরা ক্ষমতা হাতে পেয়ে পুরনো মানী লোকদের বেইজ্জত করতে লেগেছে, তাদের উদ্দেশে সুশ্রাব্য নয় এমন শব্দরাজি একটানা বর্ষণ করে গেলেন।
তারপরে একেবারে অন্য মানুষ বনে গেলেন। বসলে উঠবার কথা ভুলে যেতেন। ভাতের থালা নিয়ে ঠায় বসে থাকতেন। গ্রাস মুখে তুলতে গিয়ে কি ভেবে শিউরে উঠতেন, হাতের গ্রাস মাটিতে পড়ে যেত। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি মোক্তার সাহেবের সঙ্গে কি প্রচণ্ড বিক্রমে লড়েছিলেন। তাঁর প্রাণশক্তি কি করে এমন থিতিয়ে এল বুঝতে পারলাম না।
তালুকদারী গেছে আমাদের কাছে সুসংবাদ বৈ এমন কিছু নয়। কিন্তু বাবার বুকে আঘাতটা বজ্ৰশেলের মতো বাজল। একটা শরিকী তালুকের সাড়ে তিন আনা অংশের মালিক ছিলেন আমার বাবা। বছরে একশ তিন টাকা বারো আনা সাত পাই খাজনা আমাদের পাওনার কথা। কিন্তু আমার বয়েসকালে কোনোদিন টাকাটা বিনা ঝাটে পেয়েছি একটুও মনে পড়ে না। বরঞ্চ কোনো কোনো বছর আদালতে তার দশগুণ ব্যয় করতে হয়েছে।
বাবার একটা প্রাণপ্রিয় স্বভাব- যাদের কাছে তিনি খাজনা পেতেন, তাদের উঠতে বসতে ছোটলোক ছাড়া ডাকতেন না। আর সেই ছোটলোকেরাই লেখাপড়া বিত্ত-বৈভবে আমাদের চাইতে অনেক বেশি সম্পন্ন ছিল। নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলেই হাতের বাঁকা লাঠিটা প্রসারিত করে গোটা গ্রামখানি দেখিয়ে বলতেন, এই যে দেখছেন চারপাশের ঘরবাড়ি এরা সবাই আমাদের সাতপুরুষের প্রজা। সাত পুরুষের প্রজারাও তাই আদালতে তালুকদার সাহেবকে না তুলে খাজনাটা কখনো হাতে হাতে পরিশোধ করত না। বাবাকে আদালতে নালিশ করতে হতো, ওরা পাল্টা জবাব দিত। এভাবে উকিল মোক্তার সাক্ষী সাবুদ পেশকার পেয়াদার পেছনে নির্ঘাত হাজারখানেক টাকা বেরিয়ে যেত। সেই তালুকদারী যাওয়াতে একটু ব্যথা পেলেও মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক মামলা মোকদ্দমা হ্যাঙ্গাম হুজ্জত পোহাতে হবে না।
বাবার শরীর দিনে দিনে ভয়ংকর রকম দুর্বল হয়ে আসছিল। তিনি ক্লোরোফর্ম করা রোগীর মতো অসাড় হয়ে পড়ে থাকতেন। যখন-তখন সে তুলোট কাগজের বংশপঞ্জিটা খুলে বসতেন। খয়েরী হয়ে আসা হরফগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন। বিড়বিড় করে বংশপঞ্জিটি আমাদের পরিবারের উত্তরণ ধারার রেখাচিত্র। কালের জল আমাদের মেদ মাংস পচিয়ে ফেলেছে একথা সত্যি, তবু কিন্তু অস্থির আড়ালে মজ্জার সঙ্গে শয়ান এক রকমের হীরকের মতো কঠিন অথচ জ্যোতিন অহংকার আমরা লালন করতাম। যতই দরিদ্র হই, সেই শিলা-দৃঢ় অহংকার ভাইবোন কেউ ভুলতে পারিনি।
এই বাঙাল মুলুকে আমাদের স্থিতি হয়েছিল সেই কবে মোগল আমলে। মোগল আমল, নবাবী আমল, ইংরেজ আমল কত কাল এল গেল । কত রাজ্য কত রাজা এসেছে আর গিয়েছে। কত যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধ্বংস-সৃষ্টি, বিপ্লব-উপবিপ্লব সবকিছুর আঘাত সহ্য করেও সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পরিবার। কোনো আকস্মিক বিপদ-আপদই আমাদের পরিবারকে স্পর্শ করতে পারেনি। অখণ্ড প্রতাপ খণ্ড-খণ্ড হয়ে পড়েছে, বিশাল জমিদারী কোথায় বিলীন হয়েছে। তারপরও এক পুরুষের পর এক পুরুষ এসেছে। হৃদয়লালিত অহংকারে ভরিয়ে দিয়ে গেছে উত্তরপুরুষের বুক। বংশপঞ্জিতে তাদের আশ্চর্য সব নাম পাঠ করে আর ততধিক আশ্চর্য কীর্তি কাহিনী শ্রবণ করে আমি নিজেও তো কতবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছি। এই সম্মোহনের মধুর স্বাদ কি করে কাটাই।
বাবার অবস্থা ভয়াবহ। এই তালুকদার শব্দটার ব্যঞ্জনায় তিনি সর্বক্ষণ মোহিত হয়ে থাকতেন। ভুলে যেতে পারতেন চারপাশের বাস্তবের রূঢ় পরিবেশ। এই পাঁচটি অক্ষরে উচ্চারিত বিশেষ ধ্বনিটির মাধ্যমে তিনি পূর্বপুরুষের নৈকট্য অনুভব করতেন। সেই তালুকদার নামটাই আইনের খড়গে কাটা পড়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন, বংশপঞ্জিতে তার নাম থাকার আর কোনো সার্থকতা নেই। চোখ কান খুঁচিয়ে উপলব্ধি করলেন- ঘুমের ভেতর স্বপ্নের যোগানদার, জাগরণে নেশাগ্রস্ত করার মহাজনদের হাট থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। বৈরী বিশ্বে দাঁড়িয়ে অস্তিত্বের অর্থহীনতা গভীর মর্মবেদনায় প্রথমবারের মতো অনুভব করলেন। অচেতন রোগী সংজ্ঞা ফিরে পাওয়ার পর একটা হাত কিংবা পা কাটা দেখে যে রকম রিক্ততা অনুভব করে তেমনি এক ধরনের রিক্ততার ভেতর ডুবে গেলেন বাবা। তাঁকে বাতে ধরে জখম করে দিয়ে গেল। তিনি উত্থান শক্তি হারালেন।