নানি বললেন, মিষ্টি মুখে দিয়ে পরিচয় করলে সারা বছর মিষ্টি কথা শুনবো।
নানিকে দিদার ঘরে রেখে ইতুরা রিমকিদের নিয়ে চিলেকোঠায় এল। বাড়ি ভাগের সময় উঁচু পাঁচিল দিয়ে ছাদও দুভাগ করা হয়েছে। ছাদে ওঠার সিঁড়ি আর চিলেকোঠা ইতুদের ভাগে পড়েছে। এত বড় ছাদ দেখে রিমকিরা বেজায় খুশি। সিমকি তো ছাদে উঠেই প্রজাপতির মতো ডানায় ভর করে এক পাক উড়ে এলো। রিমকি বললো, আহা ছাদটা যদি আমাদের হত।
ইতু বলল, রোজ এসে খেললেই হয়।
রিমকি বললো, ছোটনদের সঙ্গে বড়দার আলাপ হয়েছে বুঝি! তোমাদের বড়দিকে দেখতে হবে একবার।
ইতু বললো, বড়দি খুব রাগী মেয়ে।
রিমকি মুখ টিপে হাসলো–আমাদের দেখলে তিনি মোটেই রাগবেন না।
পৌষ মাস না আসতেই বেশ শীত পড়ে গেছে। ডিসেম্বর মাস পুরোটাই স্কুল বন্ধ। ছোটন রিমকিকে বললো, শীতে কি তোমরা পিকনিক করো?
নবরায় লেন-এর বাড়ির ভেতরে করতাম। জবাব দিলো রিমকি।
বাড়ির ভেতরে বুঝি পিকনিক করে? মুখ টিপে হাসলো মিতু। শহরের বাইরে না গেলে কিসের পিকনিক?
আমাদের ওই বাড়ির পেছনে বড় একটা আমবাগান আছে। ওখানে নিজেরা রান্নাবাড়ি করতাম।
আমরা প্রত্যেক বছর পিকনিকে যাই। ভঁট দেখিয়ে বললো মিতু তেজগাঁয়ে আমাদের একটা বাগানবাড়ি আছে। ঘোড়ার গাড়িতে যেতে দুঘণ্টা লাগে।
এ বছর যাও নি?
যাবো, এত তাড়া কিসের? ছোটন বললো, শীতটা আরো পড়ুক।
সিমকি বললো, আমাদের সঙ্গে নেবে? পিকনিকে আমরাও চাঁদা দেব।
সিমকির কথা শুনে রিমকি আর ছোটনরা একটু বিব্রত বোধ করলো। রিমকি ভাবলো বাড়িতে কারো সঙ্গে কথা না বলে হুট করে এভাবে যেতে চাওয়া ঠিক হচ্ছে না। ছোটনরা ভাবলো, দিদাকে না জানিয়ে রাজি হলে শেষে যদি দিদা বেঁকে বসেন। আমতা আমতা করে ইতু বললো, একসঙ্গে পিকনিক করলে ভালোই হবে। তবে সবকিছু ঠিক করেন দিদা আর বড় জেঠু। ওঁদের আগে বলতে হবে।
রিমকি কাষ্ঠ হেসে বললো, সিমকি এমনি বলেছে। নানি আমাদের যেতে দিলে তো!
দুখির মা এসে বললো, ম্যামানগো দাদিআম্মায় মিষ্টি খাওনের লাইগা বোলায়! চলেন গো সোন্দর মাইনষের সোন্দর মাইয়ারা।
রিমকি-সিমকি দুখির মার সঙ্গে চলে গেলো। রন্টু বললো, সবাই মিলে একসঙ্গে পিকনিকে গেলে কী মজাই না হবে!
ঝন্টু বললো, মনে হয় না দিদা রাজি হবেন।
ছোটন বললো, দিদাকে রাজি করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
কীভাবে দিদাকে রাজি করানো যেতে পারে এ-নিয়ে ওরা অনেক জল্পনা-কল্পনা করলো। শেষে ঠিক হলো সাইফ ভাইকে দিয়ে কথাটা প্রথম বড়দিকে বলতে হবে। বড়দি সেটা দিদার কাছে পাড়বে। বড়দের ভেতর লেখাপড়ায় ভালো বলে বড়দিকে দিদা একটু বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু কখনো সেটা কাউকে বুঝতে দেন না। তবে ছোটরা অনেক কিছুই লক্ষ করে, যা বড়দের চোখে পড়ে না।
একটু পরে ছুটতে ছুটতে রিমকি-সিমকি এসে বললো, আমরা এখন যাচ্ছি। কাল সকালে বাগানে এসো।
রিমকিরা চলে যাওয়ার পর ছোটনরাও নিচে নামলো। শুধু ইতু ওর শেষ না-করা বইটা নিয়ে বসলো।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নামলে প্রথমে পড়ে ঢাকা-বারান্দা। বারান্দার পাশে আগে বসার ঘর, তার পর দিদার আর অন্যসব ঘর। ছোটরা ভেবেছিলো দিদার ঘরের পাশ দিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে যাবে। সন্ধে হতে চলেছে, এ-সময় বাইরে যাওয়া বারণ। অথচ পিকনিকের কথাটা সাইফ ভাইকে না বললেই নয়। ছোটদের স্কুল বন্ধ থাকলেও মেডিকেল কলেজে ক্লাস হচ্ছিলো। সাইফ ভাই কালই পিকনিকের কথাটা বড়দিকে বলতে পারে। বড়দিদের ক্লাস না থাকলেও ও রোজ কলেজে যায়। নাকি যে-কোনো দিন ফল বেরোবো।
দিদা কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। ওঁর একটা কথা ছোটনদের কানে যেতেই ওরা থমকে দাঁড়ালো। দিদা বলছিলেন, ওসব হচ্ছে বড়লোকি ঢং। নাকি কুমিল্লা থেকে রসমালাই এনেছেন! কে খাবে ওসব! দিও ওই ছেঁড়াগুলোকে, আহ্লাদ করে দোতালায় নিয়ে এসেছে। নিচের বসার ঘরে বসালেই হত!
বড় ফুপি বললেন, আমার তো ভদ্রমহিলাকে ভালোই মনে হলো। বেথুন থেকে বি এ পাশ করেছেন, এতটুকু অহংকার নেই।
পড়ার নেই তো কী হয়েছে! রূপের অহংকার তো ষোলআনাই আছে। শুনলে না, হাসতে হাসতে দিব্যি বললো, আমাদের বংশে কালো কেউ নেই!
না থাকলেও কি আছে বলবে আম্মা? দেখলেনই তো নানি-নাতনি সবাই কী সুন্দর!
তোমার কি আর কোনোকালেই বুদ্ধিসুদ্ধি হবে না আকিকুননেসা? নেই তো নেই, সেটা বড় গলায় বলাটা মোটেই ভালো শোনায় না। তোমাকে আরো বলি বাছা, কিটকিটে ফর্শা হলেই যে মানুষ সুন্দর হয় যারা এমন মনে করে, তাদের সবাই বোকার হদ্দ বলে। যাক, এসব নিয়ে আলোচনা না করে রান্নাঘরে গিয়ে তোমার ছোট চাচার জন্য কখানা রুটি বানিয়ে দাও গে। ওর তো আবার তোমার রুটি ছাড়া মুখে রোচে না।
বড়ফুপি ঘর থেকে বেরোবার আগেই ছোটনরা ঝুলবারান্দায় চলে গেলো। রিমকির নানির ওপর ভীষণ রেগে আছেন দিদা–এ-কথাটা ভাবতেই ওদের পিকনিকে যাওয়ার উৎসাহ থিতিয়ে গেলো। বড় ফুপির সঙ্গে ওঁর কথা থেকে এটুকু শুধু পরিষ্কার হয়েছে ও-বাড়ির সবাই ফর্শা বলে দিদার যত রাগ। কারণ এ-বাড়িতে দিদা ছাড়া আর কেউ ও-বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতো ফর্শা নয়।
বড় ফুপির পেছন-পেছন দিদাও যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন ছোটনরা টের পায় নি। বারান্দায় ওদের দেখে দিদার মনে হলো এগুলোকে এখন থেকে সাবধান করে দিতে হবে। কাছে গিয়ে শান্ত গলায় বললেন, শুনলাম আজ সকালে নাকি তোমরা দশআনি বাড়িতে গিয়েছিলে? মতলব কী শুনি!