দিদা ধমক দিয়ে বললেন, কলেজে পড়ায় বলতে হয় না, পড়ান বলবে। আদব-কায়দা সব কি শিকেয় উঠেছে?
ভালো বাজার করার পরও মিতুর জন্য দিদার ধমক খেয়ে ছোটনের মন খারাপ হয়ে গেলো। দিদারও রাগের কারণ ছিলো। সকালে গিরিবালা ধোপানি ও-বাড়ির লোকদের সম্পর্কে যে-সব কথা বলেছে, শোনার পর থেকে দিদার মন ভালো নয়।
ছোটন আর মিতু ওপরে ওদের চিলেকোঠার ঘরে এসে দেখে ইতু একা খাটে শুয়ে আছে। পাশে অযত্নে খোলা পড়ে আছে রহস্যলহরী সিরিজের বই। ছোটন জানতে চাইলো, রন্টু ঝন্টু কোথায় গেছে?
ইতু মুখ ভার করে বললো, তোমাদের নতুন পাওয়া বান্ধবীদের সঙ্গে বসে গল্প করছে।
ওরা কি ডেকেছিলো?
ডাকলে তো কথা ছিলো না। বেহায়ার মতো নিজেরা গেছে কথা বলতে! মেয়ে দুটো ভাববে আমরা কী হ্যাংলা গায়ে পড়ে আলাপ করতে চাচ্ছি।
তা কেন ভাববে? মিতু বুঝিয়ে বললো, ওরা কখনো আমাদের হ্যাংলা ভাববে না। বন্ধুত্বের জন্য ওরা আমাদের সব শর্ত মেনে নিয়েছে। তুই যাস নি কেন?
গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।
জানিস, বাজারে যাওয়ার পথে এক কাণ্ড হয়েছে। এই বলে সাইফের সঙ্গে পরিচয়ের কথা ইতুকে সব জানালো ছোটন। বয়সে একবছরের ছোট হলেও ইতুর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় ও বুঝি স্কুল পেরিয়ে গেছে।
সাইফের কথা শুনে ইতু উঠে বসলো। বললো, বড়দিকে বলবি না?
মিতু বললো, ধমক খাবে কে, তুই?
আমার মনে হয় না বড়দি ধমক দেবে। বিজ্ঞের মতো বলল ইতু।
ছোটন বলল, চল তাহলে। আমার তো মনে হয় বড়দির ধমক থেকে বাঁচার একটা ব্যবস্থা আমরা করতে যাচ্ছি। বড়দি উল্টোপাল্টা কিছু বললে সাইফ ভাইকে বলে দেব না!
ইতুদের বড়দি ওর ঘরে বসে পেল্লাই আকারের গ্রের এ্যানাটমির বই খুলে কী যেন দেখছিলো। ছোটন নিরীহ গলায় বললো, বড়দি তুমি সাইফ ভাইকে চেনো?
ঘাড় বাঁকিয়ে বড়দি ওর দিকে তাকালো। ভুরু কুঁচকে রাগী গলায় বললো, সাইফ ভাই কে?
ডাঃ সাইফ হায়দার চৌধুরী। তোমাদের কলেজে নাকি পড়ান?
বড়দির কোঁচকানো ভুরু স্বাভাবিক হলো। গলা থেকে সমস্ত রাগ কর্পূরের মতো উবে গেলো–চিনবো না কেন? সপ্তাহে আমাদের দুটো ক্লাস নিতেন তিনি। তোরা জানিস কীভাবে?
পরিচয়ের বৃত্তান্ত শুনে বড়দির চেহারা কোমল হয়ে এলো। বলল, তিনি সত্যি সত্যি বলেছেন আমি লক্ষ্মী মেয়ে?
সত্যি বলছি বড়দি। তোমার অনেক প্রশংসা করেছেন।
আর কী বলেছে? বড়দির কান লাল হলো।
বলেছে, পড়াশোনার ব্যাপারে তুমি নাকি খুব সিরিয়াস।
মৃদু হেসে বড়দি বললো, তিনি নিজেও লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস।
মিতু বললো, সাইফ ভাইর ছোটবোন দুটোও খুব ভালো। আজ সকালে নিজে থেকে ওরা আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে।
ভালোই তো। নরম হেসে বড়দি বলল, সাইফ ভাইর বোন যখন নিশ্চয় খুব সুন্দর দেখতে!
একেবারে পরির মতো। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো মিতু।
বড়দির হাবভাব দেখে ইতু খুব অবাক হলো। অনেক চেষ্টা করেও ও মনে করতে পারলো না, বড়দি কারো সঙ্গে হেসে কথা বলেছে।
বিকেলে ওরা রোয়াকে বসে এ নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললো। সবশেষে ইতু উপসংহার টানলো, এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সাইফ ভাইর নামের একটা আলাদা জাদু আছে।
ছোটন বলল, জীবনেও আমি বড়দিকে হাসতে দেখি নি।
ওদের ভেতর বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম হলো রন্টুর। বলল, বড়দির সঙ্গে সাইফ ভাইর বিয়ে হলে দারুণ মানাবে।
ইতু ধমক দিয়ে বললো, অসভ্যের মতো কথা বলিস না রন্টু। দিদার কানে গেলে সবার পিঠের চামড়া তুলবেন।
মুখ কালো করে রন্টু বললো, আমাদের নিজেদের সব কথা দিদাকে বলতে হবে কেন? আমি–
রন্টুর কথা শেষ হলো না। সিং দরজার দিকে মুখ করে বসেছিলো মিতু। বললো, আরে, রিমকিরা আসছে যে!
সবাই ঘুরে তাকালো। রিমকি-সিমকির সঙ্গে দিদার বয়সী এক মহিলা। এত বয়স হয়েছে তবু কী সুন্দর দেখতে! রিমকি এগিয়ে এসে বললো, আমাদের নানি তোমাদের দিদার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।
সবার পেছনে ছিল রিমকিদের কাজের বুয়া বেদানার মা। হাতে মিষ্টির দুটো হড়ি। ইতুরা উঠে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে বললো, স্লামালেকুম!
রিমকির নানি মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। বেদানার মা একগাল হেসে বললো, ওয়ালাইকুম সালাম। কী লক্ষ্মী সব পোলাপাইন। তোমাগো দাদিআম্মা কই গো?
ওরা রিমকিদের ভেতরে নিয়ে গেলো। যেতে যেতে রিমকি ইতুকে বললো, তুমি বুঝি অর্জুন?
ইতু গম্ভীর হয়ে বলল, আমার নাম ইখতিয়ারউদ্দিন খান তরফদার।
জানি। মুখ টিপে হেসে রিমকি বললো, সারাক্ষণ তুমি বই নিয়ে পড়ে থাকো, আর ক্লাসে সবসময় ফার্স্ট হও। তোমার সব কথা আমি শুনেছি।
রিমকির কথা শুনে ইতুর মনটা নরম হলো। যতটা ভেবেছিলো এরা ততটা খারাপ নয়। খারাপ কেন ভালোই বলতে হবে। এত মিষ্টি নিয়ে পাড়ার কেউ কখনো ওদের বাড়িতে দেখা করতে আসে নি। ইতুর ফার্স্ট হওয়ার খবরও জেনে গেছে। বললো, ফার্স্ট হওয়া এমন কী কঠিন কাজ!
তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কে ফার্স্ট হতে যাবে বলো। শোনার পর থেকে ভাবছি তোমার ইংরেজি নোটের খাতাটা দেখবো। ইংরেজিতে আমার নম্বর কখনো পঞ্চাশের ওপর ওঠে না।
ঠিক আছে, কাল এসো–দেখাব।
দিদা ওঁর ঘরে ছিলেন। রিমকির নানি অমায়িক হেসে বললেন, আপনাদের নতুন প্রতিবেশী আমরা। পরিচয় করতে এলাম।
রিমকি, সিমকি এসে দিদাকে সালাম করলো। মিষ্টির হাড়ি দুটো টেবিলের ওপর রেখে বেদানার মাও রিমকিদের মতো দিদার পা ধরে সালাম করলো। দিদা কাষ্ঠ হেসে একবার বললেন, থাক বাছা থাক। আরেকবার বললেন, এত মিষ্টি আনবার কি দরকার ছিলো?