বাজার করতে ছোটনের আপত্তি নেই। দুআনা চারআনা যা বাঁচে সেটা ওর। তবে চারআনার বেশি বাঁচলে দিদা পুরোটাই নিয়ে নেন। সেজন্যে যা-ই বাজার করুক ছোটন হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। এখন ও চারআনার বেশি বাঁচায় না।
দিদা ক্লাস নাইনের ছোটনের হাতে বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, চার আনা বাঁচাবার জন্য সেদিনের মতো আবার পচা বেগুন আনিস না!
ছোড়দি ফোড়ন কাটলো, চারআনা না আটআনা বাঁচায় তুমি কি বাজারে গিয়ে দেখেছো দিদা!
বেআক্কেলে কথা বলবে না হোসেনেআরা। আমি কোন্ আহ্লাদে বাজারে গিয়ে দেখতে যাবো?
বড়দের সবাইকে দিদা পোষাকি নামে ডাকেন। যখন থেকে তিনি কাউকে পোষাকি নামে ডাকা শুরু করবেন, তখন থেকে বুঝতে হবে তারা বড় হয়ে গেছে, কথা বলতে হবে হিসেব করে। অল্প কদিন ধরে ছোড়দিকে দিদা পোষাকি নামে ডাকা আরম্ভ করেছেন।
বাজারে যাওয়ার সময় ছোটন মিতুকে সঙ্গে নিয়ে যায় ব্যাগ বয়ে আনার জন্য। এর জন্য ওকে দুপয়সার পেয়ারা নয়তো অন্যকিছু কিনে দিতে হয়। ছোটরা বাজারে যাওয়ার পর ঝন্টু ইতুকে বললো, যাবি নাকি নারকেলি পাড়তে?
ইতু ভুরু কুঁচকে বললো, ও-বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য বুঝি তর সইছে না!
তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি! এই বলে নিরীহ রন্টুকে সঙ্গে নিয়ে ঝন্টু দশআনি বাড়িতে গেল কুল পাড়তে।
ইতু রহস্যলহরী সিরিজের নতুন বইটা নিয়ে চিলেকোঠার ঘরে পড়তে বসলো। ওদের ক্লাসের বিজনের কাছ থেকে এনেছে, অর্ধেকের বেশি পড়াও হয়ে গেছে; পরশু ফেরত দিতে হবে। কয়েক পাতা পড়ে ওর মনে হল ঝন্টুর সঙ্গে যাওয়া উচিত ছিলো। আরো দুপাতা পর নায়ক যখন পাহাড়ের চূড়ায় ভিলেনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে হঠাৎ ছিটকে পড়েছে কিনারে, কোনোরকমে একহাত দিয়ে পাথরের কার্নিশ ধরে ঝুলছে ছহাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে, তখন ইতুর মনে হলো ঝন্টুরা কী করছে দেখা দরকার। বই রেখে সে উঠে পড়লো।
ছাদের ওপর থেকে দশআনি বাড়ির বাগান পুরোটা দেখা যায়। ইতু তাকিয়ে দেখলো কুলগাছের পাশে ঘরের ওপর বসে মেয়ে দুটোর সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছে ঝন্টুরা। হাঁদারাম রন্টুটা অসভ্যের মতো হাসছেও। রাগে ইতুর গা জ্বলে গেলো।
.
০২. দশআনির ওপর দিদার রাগ
ছোটন আর মিতু বাজারে যাওয়ার জন্য সদর দরজা দিয়ে বেরোতেই সামনে পড়ল দশআনির রিমকিদের বড়ভাই। ছোটনদের মেজদার বয়সী হবে, চব্বিশ-পঁচিশের কাছাকাছি, দেখতে মেজদার চেয়ে অনেক সুন্দর, দেব সাহিত্য কুটিরের বইয়ের ছবিতে যেমন দেখা যায়। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা থাকাতে একটু বেশি ভারিক্কি মনে হচ্ছিলো, পায়জামা-পাঞ্জাবিপরা, হাতে বাজারের থলে।
ছোটনদের দেখে অমায়িক হেসে মার্জিত গলায় যুবকটি বললো, তোমরা বুঝি এ-বাড়িতে থাকো! আমরা কাল এসেছি তোমাদের যমজ বাড়িতে।
গম্ভীর হয়ে ছোটন বললো, জানি। সকালে রিমকিদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আপনি তখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন।
তাই বুঝি! কই তখন তো আমার সঙ্গে পরিচয় করতে এলে না? মিতু ফিক করে হেসে বললো, পাড়ায় যারা নতুন আসে তারাই আগে এসে পুরোনোদের সঙ্গে পরিচয় করে!
বাব্বা, এতোও জানো! ঠিক আছে, পরিচয় দিচ্ছি। আমার নাম সাইফ হায়দার চৌধুরী। দুবছর ধরে মেডিকেল কলেজে পড়াই। তিন ভাই চার বোনের ভেতর আমি সবার বড়! এই বলে রিমকির ভাই ছোটনদের দিকে হাত বাড়ালো।
ছোটনরা ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলো। বললো, আপনাকে আমরা সাইফ ভাই বলবো।
সাইফ মৃদু হেসে বললো, তোমাদের খুশি। বাজারে যাচ্ছ নিশ্চয়? চলো একসঙ্গে যাই।
ছোটন বললো, আপনি কি সত্যি সত্যি ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ান?
হ্যাঁ।
আমাদের বড়দি মেডিকেলে পড়ে।
তাই নাকি! কোন্ ইয়ারে?
ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। রেজাল্ট এখনো দেয় নি।
কী নাম বলতো?
জাহানারা তরফদার।
জাহানারা তোমাদের বড়দি? খুব ভালো করেই চিনি। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে।
সাইফের কথা শুনে ছোটন আর মিতু একে অপরের দিকে তাকালো। বাড়িতে বড়দির ধমকের ভয়ে ওরা পালিয়ে বাঁচে না, আর তার টিচার বলছে লক্ষ্মী মেয়ে!
কথাটা বলেই ফেললো মিতু–বড়দি কিন্তু খুব রাগী।
তাই নাকি! সাইফ হেসে বললো, জাহানারাকে কিন্তু কখনো আমার রাগী মনে হয় নি। লেখাপড়ার ব্যাপারে ও খুব সিরিয়াস।
বড়দি রোজ ছ-সাত ঘণ্টা পড়ে। লেখাপড়ার ব্যাপারে সিরিয়াস–এটাও মিথ্যে নয়, তবে লক্ষ্মী মেয়ে কথাটা ওকে মানায় না।
সাইফ ওদের বাড়ির কথা আরো জানতে চাইলো। কে কী করে, আগে কোথায় ছিলো, বড় হয়ে ওরা কে কী হবে এসব মামুলি কথা। সাইফের সঙ্গে বাজার করতে গিয়ে ছোটনদের ভালো-ভালো জিনিস কিনতে হলো। চারআনা বাঁচাবার কথা আর মনে থাকলো না। বাজারে চমৎকার ভঁসা পেয়ারা উঠেছিলো। মিতু কেনার কথা বলতে ভুলে গেলো। সাইফের সঙ্গে কথা বলে ওরা দুজন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ওর মহাভক্ত হয়ে গেলো।
বাড়ি ফেরার পর বাজার দেখে দিদা ভারি খুশি। বললেন, বাজারে আজ এত ভালো তরকারি উঠেছে কেন রে ছোঁড়ারা? নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে?
মিতু বলল, আজ যে সাইফ ভাই আমাদের সঙ্গে বাজার করেছেন!
সাইফ ভাই আবার কে? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন দিদা।
দশআনিতে কাল যারা এসেছে। জানো দিদা, সাইফ ভাই বড়দিকে ভালো করে চেনে! বড়দিদের কলেজে পড়ায়।