গিরিবালা চলে যাওয়ার মিনিট কুড়ি পরে ছআনি শরিকের চিলেকোঠার ঘরে দেখা গেল এ-বাড়ির ইতু, মিতু, রন্টু, ঝন্টু আর ছোটনকে। পাড়ার সবাই ওদেরকে পঞ্চপাণ্ডব বলে। দিদার কাছে মহাভারতের গল্প শুনে নিজেরা সাইজমতো নাম মিলিয়ে নিয়েছে। সবার বড় মিটমিটে পাজি ছোটন হল যুধিষ্ঠির। গায়ে-গতরে বড়সড় মিতু হল ভীম, সবচেয়ে বুদ্ধিমান ইতু বলেছে সে নাকি অর্জুন আর সেজকাকার জমজ পাজি দুটো হল নকল সহদেব।
গিরিবালার অস্পষ্ট খবরের জন্য বসে থাকে নি পঞ্চ পাণ।ডব। মিতুকে নিয়ে নিজেদের কাঁচাপাকা কুল পাড়ার সুবাদে দশআনি শরিক থেকে সকালেই ঘুরে এসেছে ছোটন। ছআনির ঝাকড়া নারকেলি কুলগাছের অর্ধেক পড়েছে দশআনির বাগানে। পাড়তে হলে ওদিক থেকেই সুবিধে। পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে মিতু তুমুল জোরে ডাল ঝাঁকাচ্ছিলো আর ছোটন টপাটপ করে ঝরেপড়া কুল কুড়োচ্ছিলো, তখনই দেখলো ওদের কাছাকাছি বয়সী ফ্ৰকপরা দুটি মেয়ে সদ্য চুনকাম করা দশআনি বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। বয়সে অল্প ঘোট মেয়েটা দুপাশে দুটো বেণী ঝোলানো, কাছে এসে রিনরিনে গলায় বললো, তোমরা আমাদের গাছের বরই পাড়ছ কেন? এক্ষুণি চলে যাও এখান থেকে।
সাদা রিবন দিয়ে পনিটেল চুল বাঁধা মেয়েটা ওকে চাপা গলায় বলল, এই সিমকি কী অসভ্যতা হচ্ছে, ওটা আমাদের গাছ নাকি! ওদের গাছেরটা ওরা
পাড়ছে, তুই চেঁচাচ্ছিস কেন?
সিমকি অবাক হয়ে বলল, বারে ছোটপা, তুই-ই তো বললি ওদের সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য এভাবে ধমক দিতে! এখন যে বড় অসভ্যতা বলছিস?
সিমকি এসে যেভাবে ওকে ধমক দিয়ে কথা বলছিলো, ছোটন ভেবেছিলো শক্ত একটা জবাব দেবে। ওর পরের কথা শুনে হাসি চেপে আবার কুল কুড়োতে লাগলো। এক ফাঁকে আড়চোখে দেখলো সিমকির কথা শুনে পনিটেল-এর ফর্শা মুখ লাল হয়ে গেছে। আরো চাপা গলায় ও সিমকিকে বললো, তুই একটা হদ্দ বোকা মেয়ে সিমকি, ওদের চলে যেতে বলছিস কেন?
সিমকি বুঝে উঠতে পারলো না ও কী বলবে। অবাক হয়ে নিজের বোনকে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর কাছে এসে ছোটনকে বললো, এই তোমরা আমাদের সঙ্গে ভাব করবে?
ছোটন হাসি চেপে গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলল, তোমরা কারা?
বারে, দেখ নি বুঝি, আমরা যে কাল সন্ধ্যায় এলাম! এটা তো আমাদের বাড়ি। তোমার নাম কী?
আমাদের দুটো নাম আছে, কোটা বলবো?
তোমার যেটা খুশি বলো।
আমার নাম যুধিষ্ঠির আর ওর নাম ভীম।
নাম শুনে দুই বোন হেসে গড়িয়ে পড়লো। হাসতে হাসতে পনিটেল বললো, আমাদের আগের বাড়িতে যে গোয়ালাটা দুধ দিতো ওর নাম ছিলো যুধিষ্ঠির আর
ভীম আমাদের জুতো মেরামত করতো।
মিতু রেগে গিয়ে বললো, মহাভারত পড়লে এমন অসভ্য কথা বলতে না। লোকে আমাদের পঞ্চপাণ্ডব বলে, সেজন্যে ওসব নাম বলা। আমার ডাক নাম। মিতু, ওর নাম ছোটন।
সিমকি বললো, আমার নাম–
জানি, সিমকি। বাধা দিয়ে মিতু বললো, তোমার ছোটপার নাম কী নিমকি?
সিমকি হেসে বললো, না, ওর নাম রিমকি। আমার একটা ছোট ভাই আছে। ওর নাম নিমকি!
খেতে কেমন? গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলো ছোটন।
কাছে যেও। হাসতে হাসতে রিমকি বললো, কামড়ে দাঁত বসিয়ে দেবে। নতুন চারটে দাঁত গজিয়েছে। যা পায় তাই কামড়ায়।
মিতু বললো, ভাব করতে হলে আমাদের আরো তিনজন আছে। সবার সঙ্গে করতে হবে।
ঠিক আছে। সিমকি বললো, আমাদেরও দুটো মামাতো ভাই আছে–রাঙা আর পিটু। তোমরা দল ভারি করতে চাইলে আমরাও করতে পারি। জানো না তো রাঙার গায়ে কী জোর! রোজ দুবেলা জিমনাসিয়ামে গিয়ে ব্যায়াম করে।
মিতু কাষ্ঠ হেসে বললো, দেখা যাবে, পাঞ্জায় কে জেতে!
ছোটন জানতে চাইলো, এখানে আসার আগে তোমরা কোথায় ছিলে?
রিমকি বললো, নবরায় লেন-এ। এর চেয়ে বড় বাড়ি ছিল ওটা।
সিমকি বললো, ওটা ভাড়া বাড়ি ছিলো। এটা আমাদের নিজেদের।
রিমকি বললো ওরা কোন্ স্কুলে পড়ে, ছুটির দিনে কত মজা করে–এইসব। একটু পরে বাড়ির ভেতর থেকে ইতুদের কাজের ঝি দুখির মার মতো একজন কার মা এসে রিমকি-সিমকিকে ডেকে নিয়ে গেল।
ছোটন আর মিতু উত্তেজিত হয়ে ঘরে ফিরে সবাইকে কুল-পাড়া অভিযানের ঘটনা জানালো। ইতু সব শুনে গম্ভীর হয়ে বললো, গায়ে পড়ে ভাব জমাতে চাইছে–ভেবে দেখতে হবে অন্য কোনো মতলব আছে কিনা।
রন্টু বললো, তুই সব কিছুতেই সন্দ করিস। দুটো মেয়ে ভাব জমাতে চেয়েছে, এতে মতলবের কী হল?
ঝন্টু বললো, মেয়ে দুটো দেখতে কেমন রে!
মিতু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, একেবারে পরির মতো!
আহ্ আস্তে বল্! চাপা গলায় ধমক দিল ছোটন। সিঁড়িতে শব্দ শুনছিস? নির্ঘাত ছোড়দি আসছে।
ক্লাস টেন-এ উঠেই ছোড়দি নিজেকে বড়দি-মেজদির মতো বড় ভাবতে শুরু করেছে। সুযোগ পেলেই ছোট ভাইগুলোর ওপর পণ্ডিতি ফলায়। ছোটন ঠিকই ভেবেছিলো। ছোড়দি এসে বললো, স্কুল ছুটি বলে লেখাপড়া সব শিকেয় তুলে এখানে বসে আড্ডা মারা হচ্ছে বুঝি!
ছোটন বিরক্ত হয়ে বললো, তোর সামনে পরীক্ষা বলে এখনই আবোল-তাবোল বকা শুরু করেছিস! ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে জানিস না বুঝি! নতুন ক্লাসে না-ওঠা পর্যন্ত কিসের পড়া শুনি?
গাছ থেকে পড়া হতে পারে। বলল মিতু।
না আকাশ থেকে পড়া। ছোড়দির কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছি। ফোড়ন কাটলো ইতু।
রেজাল্ট বেরোবার পর পিঠে যখন বড় জেঠুর বেতের বাড়ি পড়বে তখন বুঝবে পড়া কাকে বলে। পাকামো না করে নিচে যাও। দিদা ছোটনকে বাজার করতে ডেকেছেন।