কথাটা ইতুর বড়দাদুর মনে ধরলো। শিংটোলার নিকুঞ্জ কুটিরের ছআনি অংশ দেখে তাঁর পছন্দও হলো। বাড়ি অনেক পুরোনো বটে, তিরিশ-চল্লিশ বছরে কোনো মিস্তিরির হাত লাগে নি, রঙও কেউ করে নি, তবে জায়গা অনেকখানি। পেছনের জমিতে আম, কাঁঠাল, নারকেল আর লিচুর গাছ আছে বেশ কয়েকটা। দেরি করলে যদি হাতছাড়া হয়ে যায়–কলকাতায় এসেই কাগজপত্র সব পাকা করে ফেললেন। ছআনি শরিকও ভূতুড়ে বাড়ির হিল্লে করতে পেরে ভারি খুশি।
শিংটোলার বাড়িতে আসার অনেক পরে ইতুদের জন্ম হয়েছে। বড়দাদু এ-বাড়িতে এসেই রঙ মেরামত সব করেছিলেন, তবু পুরোনো চেহারাটা রয়েই গেছে। পাড়ার লোকদের কাছে নিকুঞ্জ নারায়ণের বংশের সব কীর্তি-কাহিনী ইতুরা জন্মের পর থেকেই শুনছে। ইতুর দিদা ভীষণ কড়া মানুষ। বলেন, ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি তো, তাই এ-বাড়ি সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে। আসার পর থেকে বছরে কটা মিলাদ পড়াই হিসেব করেছিস? আমি তো চোখ বুজলেই দেখতে পাই সারা বাড়িতে ফেরেশতারা গিজগিজ করছে।
ইতুরা চোখ বুঝে কখনো ফেরেশতা দেখে নি ঠিক, তবে খারাপ কিছুও দেখে নি। দিদার কথা শুনে একদিন মিতু বললো, বাড়িতে তো আমরাই গিজগিজ করি দিদা। তুমি আমাদের কথা বলছো?
বড়রা সবাই দিদাকে আজরাইলের মতো ভয় পেলেও ছোটরা সবসময় ওঁর আহ্লাদ পেয়ে এসেছে। মিতুর কথায় দিদা এতটুকু রাগলেন না। মুখ টিপে হেসে বললেন, তোরা সব ইবলিশের ঝাড়। বাচ্চা থাকতে সবাই ফেরেশতা থাকে, তোরাও ছিলি একসময় এখন সব আস্ত শয়তান হয়েছিস।
ইতুর তিন দাদুর ছেলেমেয়ে–ওদের বাবা, কাকা, জ্যাঠা আর ফুপিরা মিলে আঠারো ভাইবোন। সবাই অবশ্য এ-বাড়িতে থাকে না। বড় দাদুর এক ছেলে রাঙা জেঠু অনেক আগে–সেই ইংরেজ আমলে ভূপালে গিয়ে আস্তানা গেড়েছেন, দেশে ফেরার কথা মুখেও আনেন না। বিয়ে করেছেন সেখানকার এক নামী বংশে। রাঙা জেঠিমার কথা ইতুরা কেবল বড়দের মুখে শুনেছে, চোখে দেখে নি। ওঁদের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করতে গিয়েছিলো কেউ বিলেতে, কেউ আমেরিকায়। পড়ার পাট শেষ করে কেউ দেশে ফেরে নি। ভূপালে রাঙা জেঠু আর জেঠিমা বাড়িতে একগাদা কুকুর আর বেড়াল পুষ্যি নিয়ে দিব্বি আরামে দিন কাটাচ্ছেন। ইতুদের আরেক কাকা থাকেন রেঙ্গুনে। তিনিও সেখানে বর্মী বিয়ে করে থিতু হয়ে বসেছেন। এ-বাড়িতে ইতুরা কাকাতো, জ্যাঠাতো ভাইবোন মিলে ডজনখানেকের মতো। ক্লাস সিক্স-এ পড়া ইতুরই বয়সী এক গণ্ডা ভাই রয়েছে।
নিকুঞ্জ কুটিরের দশআনি শরিক ইংরেজ আমলেই কলকাতায় থাকতেন। তবে ছআনির মতো সুবিধের মক্কেল না পাওয়াতে তার অংশটুকু বহুদিন খালি পড়েছিল। ইতুরা সেখানে লুকোচুরি খেলতো। বুড়ো পাহারাওয়ালা বনমালী ওদের কিছুই বলতো না। তবে গত একমাস ধরে ও-বাড়িতে ঘষামাজার কাজ শুরু হয়েছে। সেই থেকে ওদেরও সেদিকে যাওয়া বন্ধ। কারা নাকি কিনেছে ও বাড়ি।
রোববার সকালে ইতুদের বাড়ির বাসি কাপড় নিতে এসে গিরিবালা ধোপানি দিদাকে বললো, আইজকা একটু কম দিয়েন বড়মা। আইজ ম্যালা কাপড় ঘোয়ন লাগবো।
গিরিবালার কথা শুনে ভারি অবাক হলেন ইতুর দিদা। প্রতি রোববার কাপড় নিতে এসে সবসময় ও বলে, বড়বাড়ির কাপড় বেশি না ওইলে মাইনষে কি কয় বড়মা! আঠারো খানই দিলেন? কুড়ি পুরাইয়া দ্যান না গো বড় মা! কাপড় যাই দেয়া হোক গিরিবালা সবসময় বেশি ধুতে চায়। নাকি তার পোষায় না।
ইতুর দিদা জানতে চাইলেন, আজ যে বড় কম নিতে চাইছিস গিরি! আর কোন রইসের কাপড় ধুচ্ছিস শুনি?
দোক্তাওয়ালা বড় একখিলি পান মুখে দিয়ে বুড়ি গিরিবালা বললো, আপনেরা অখনও হোনেন নাই বড়মা? দশআনি বাড়িত নতুন ভাড়াইটা আইছে। ক্যামন মানুষ আইলো দ্যাখতে গেছিলাম কাইল রাইতে। পয়লা দিনই দশআনি গিন্নিমা পঞ্চাশখানা ধরায়া দিছে।
ওমা কখন এল, দেখি নি তো! ইতুর মেজো জেঠিমা শুনে অবাক হলেন–কারা এসেছে গো গিরিবালা?
দিদা গম্ভীর হয়ে মেজো জেঠিকে বললেন, আমার কথার মাঝখানে কথা বলো কেন? আফসারউদ্দিনের ওঠার সময় হয়ে গেছে। যাও, ওর চা দিয়ে এসো।
মেজো জেঠিমা জিভ কামড়ে সরে গেলেন সামনে থেকে। দিদা বললেন, ওদের কর্তা কী করে শুনেছিস?
গিরিবালা ঢক করে পানের পিক গিলে বললো, তা কইবার পারুম না। তয় গিন্নিমা যে কী সোন্দর দেখতে! এত বয়স হইছে–মুখখানা দুম্না পিতিমার মতোন। বাড়ির বউ-ঝিরাও পরির মতোন। পোলারাও কম সোন্দর না বড়মা।
দিদার ভারি দুঃখ এ-বাড়িতে তাঁর মতো দুধে আলতায় গায়ের রঙ আর কারো নয়। মেয়েগুলো বেশিরভাগই শ্যামলা, বড় নাতনীটি যা কিছুটা ফর্শা। আর ছেলেগুলোকে কালোই বলতে হয়। দশআনির নতুন ভাড়াটেদের মেয়েরা পরির মতো শুনে তিনি খুশি হলেন না। তাঁর সাবালক নাতি রয়েছে গোটা চারেক, দুই নাতনীর বিয়ের বয়স হয়েছে। বড়টির জন্য ঘটকও লাগিয়েছেন। অপ্রসন্ন গলায় দিদা গিরিবালাকে বললেন, ও-বাড়ির কাপড় ধুয়ে যদি তোর সময় না থাকে তাহলে থাক, আমি হরিমতিকে খবর দিই। আজকাল তোর থোয়াও ঠিক হয় না।
গিরিবালা বললো, এইটা কেমুন কতা বড়মা! আপনেগো কাপড় ধুইবার পারুম না–এ-কতা কইলে আমার মুখে বিলাই মুতবো না! আপনে আমার কম উস্কার করছেন বড়মা! দরকার ওইলে ওই বাড়ির কাপড় আর ধুমু না।