যুগের হাওয়ার প্রচণ্ড একটা অস্থিরতা। কোথাও শান্তি নেই। বাতাসে বাতাসে মোচড় খেয়ে ঘূর্ণি হাওয়া যেমন বেগ সঞ্চয় করে, তেমনি মানুষের ক্ষোভ রুদ্ধ আক্রোশে ফুলে ফুলে একটা সৃষ্টিনাশা ঝড়ের আকার ধারণ করছিল। যেখানেই যাই- দেখি তোলপাড় লণ্ডভণ্ড অবস্থা। বিপদ ঘনিয়ে এলেই আমি কোনো বিষয়ে স্থিরভাবে চিন্তা করতে পারিনে। বলির পাঁঠার মতো নির্বিকার দাঁড়িয়ে সর্বনাশের প্রতীক্ষা করি। বাইরের দিক থেকে আমার মানসিক অবস্থা অনুমান করার উপায় নেই। আমার চিন্তা চাঞ্চল্যহীন নির্বিকারত্বকেই লোকে ক্লাসিক স্থিরতা বলে মনে করে। এত বেশি শুনেছি যে কথাটা নিজেও প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম।
চুপচাপ বসে থাকি। অফিসে যাওয়া আসার পথে পারতপক্ষে ডাইনে বাঁয়ে তাকাইনে। রাতের অন্ধকারে বেবাক রাস্তায় কারা সব ভয়ংকর পোস্টার সেঁটে রাখে। পোস্টারের বুকে সর্বনাশের লাল সংকেত জ্বলজ্বল করে। তাই ভাবুকের মতো আকাশের দিকে তাকাই। সেখানেও মাঝে মাঝে দেখতে পাই, মেঘে মেঘে ঘষা লেগে বিজলীর বাঁকা ছুরি ঝলসে উঠে। বজ্র ফেটে পড়ে। প্রকৃতির রাজ্যের নিটোল শান্তি ভাঙ্গার অপরাধে আকাশের দেবতাকে অভিযুক্ত করি। পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছি। পত্রিকাঅলাদের আমি বিশ্বাস করিনে। কি করে করব। আমার শ্বশুর সাহেব যে পত্রিকাটিকে তার প্রভাব খাঁটিয়ে ব্যাংক থেকে লোন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, দেখলাম সে ব্যাটাই আমার শ্বশুরের দলের বিরুদ্ধে তেজালো লেখা লিখছে। বাজারের কসবীকে বিশ্বেস করা যায়, কিন্তু পত্রিকাঅলাদের নয়।
আগে অল্পস্বল্প এটাসেটা পড়াশোনা করতাম। এখন সব ছেড়ে দিয়েছি। উসকোখুসকো লাগলে নবযুগ ডাইরেকটরী পঞ্জিকার পাতা উল্টাই। রাশি বর্ষ ফল দেখি। মেহ-প্রমেহ ইত্যাদি যৌন রোগের বিজ্ঞাপনে চোখ বুলোই। তাছাড়া আর কি। করার ছিল আমার। দেখতে পাচ্ছিলাম চারিদিকে সব দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমার মনের গহনে তখনো একটা নিশ্চিন্তি বোধ নোঙরের মতো অটুট ছিল।
আমি জানতাম আমার একটা বৌ আছে। ছায়াময় উদ্যানকুঞ্জের মতো সে বৌয়ের একখানা স্নেহপ্রবণ মন আছে। এই বিশ্বসংসারে একমাত্র আমিই সে মনের খবর জানি। সে তো বোবা। মানুষের জয়-পরাজয় উত্থান-পতনে তার কিছু যায় আসে না। সুতরাং মানুষও সে মনের কোনো খবর জানত না। সময়ে অসময়ে জাগতিক অশান্তি অস্থিরতা আমাতে ভর করলে, মরুভূমির পথিক যেমন পান্থপাদপের ছায়ায় এসে দাঁড়ায়, তেমনি ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াব ভেবেছিলাম। আমার সুখ-দুঃখ সব কিছুর ওপর তার মনের অনাবিল শান্তি প্রসন্ন মাধুর্যে ভরিয়ে দেবে। কল্পনা করে সুখ, আমিও কল্পনা করেছিলাম।
৮. স্লোগানের আওয়াজ
বহুরূপী – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির
০১. শিংটোলার ছআনি দশআনি
শিংটোলার জমিদারদের নিকুঞ্জ-কুটিরের মতো বড় আর পুরোনো বাড়ি গোটা তল্লাটে দ্বিতীয়টি নেই। সেই কোম্পানির আমলের বানানো। বংশের আদিপুরুষ নিকুঞ্জ নারায়ণ রায়ের নামে এ-বাড়ি বানিয়েছিলেন তার অধস্তন চতুর্থ পুরুষ কালী নারায়ণ রায়। জয়পুর থেকে মার্বেল আনানো হয়েছিলো, কড়ি-বরগা আর দরজা-জানালার কাঠ এসেছিলো বার্মা থেকে, ঝাড়লণ্ঠন এসেছিলো ভেনিস থেকে–সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড।
পাড়ার লোকেরা অবশ্য অনেক আজেবাজে কথা বলতো। নাকি নিকুঞ্জ নারায়ণ রায়ের বংশে ফাঁসুড়ের রক্ত আছে। যদিও কালী নারায়ণ বলতেন ইদ্রাকপুরে তাদের জমিদারি কেনা হয়েছিলো স্বপ্নে পাওয়া গুপ্তধনের টাকায়, অনেকে সেসব কথা বিশ্বাসও করতো, তবে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা কোনোকালেই কম ছিলো না।
অত জাঁকজমক করে বাড়ি বানানো, লক্ষ্ণৌ থেকে বাইজি আর গানের ওস্তাদ আনিয়ে নবাবদের সঙ্গে টক্কর দেয়া–সবকিছু তিন পুরুষেই কপুরের মতো উবে গেলো। কালী নারায়ণের চতুর্থ পুরুষে এসে শরিকদের ভেতর সম্পত্তি ভাগ হলো। দেনার দায়ে বসতবাড়ি ছাড়া বাকি সবই নিলামে উঠলো। নিকুঞ্জ কুটিরের দশাও একরকম না থাকার মতোই। কোথায় গেলো ভেনিসের ঝাড়বাতি, দরজা-জানালার বর্মী-নক্সা আর দেয়ালের চকমিলান কারুকাজ! সিংহদরজার থামের ওপর বসানো সিংহ দুটোর দশাও তেমনি। একটার লেজ উড়ে গেলো কবে কেউ টেরও পেলো না, আরেকটার সামনের এক ঠ্যাং ভাঙা–দুটোরই আস্তর খসে ভেতরের সুরকি বেরিয়ে গেছে।
ইংরেজদের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর ইতুর বড়দাদু ঠিক করলেন কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসবেন। ওঁদের ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িটা প্রথমে বিক্রি করার জন্য দালাল ধরলেন। সে-সময় বাড়ি কেনার গরজ নেই কারো। উল্টোপাল্টা দাম বলার জন্য তিন তিনটে দালাল ইতুর বড়দাদুর লাঠিপেটা খেয়ে পালালো। ওঁর সঙ্গে স্কুলে পড়তেন ঢাকার নিকুঞ্জ কুটিরের ছআনি শরিকদের এক ছেলে। পরে বাপ মরার পর নিজেই মালিক হয়েছেন, তবে ঢাকার বাড়ির খোঁজখবর সামান্যই রাখতেন। এক বিটকেল নায়েব ছিলো, বাড়িতে সে ভাড়াটে বসিয়েছিলো। বছরে একবার এসে কিছু টাকা দিয়ে যেতো, বারো মাসের ভাড়া যা হওয়ার কথা তার অর্ধেকেরও কম। বলে নিকুঞ্জ কুটির নাকি ভুতুড়ে বাড়ি, বেশিদিন কোনো ভাড়াটে থাকে না, ন্যায্য ভাড়াও পাওয়া যায় না।
বাড়ি বিক্রির খবর শুনে ছআনি শরিক একদিন নিজে এলেন ইতুর বড়দাদুর সঙ্গে দেখা করতে। ভূতের কথা গোপন করে বন্ধুকে বললেন, যখন ঢাকা যাবে। ঠিক করেছো, তখন আমার বাড়িটা গিয়ে একদিন দেখে এসো। তোমার পছন্দ হলে আমি ওটার সঙ্গে তোমার এ বাড়ি বদল করতে পারি।