একদিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখি সে বিছানায় নেই। বাথরুমে খুঁজলাম, বারান্দা খুঁজলাম। এঘর ওঘর তালাশ করে, বোনের গানের প্র্যাকটিস করার ঘরে দেখি হারমোনিয়ামটাকে বাচ্চা শিশুর মতো কোলে নিয়ে বসে। খুব সন্তর্পণে একেকটা রীড টিপছে। একবার টিপে একবার ওদিক তাকায়। বড় ভয়, পাছে কেউ দেখে ফেলে। হারমোনিয়াম থেকে মিহি স্থূল আওয়াজ বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখে রঙের বদল ঘটছে। জানালার পাশ ধরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ এ দৃশ্য দেখলাম। শেষে ঘরে ঢুকি। তার চোখে মুখে একটা অপরাধীর ভাব । হাত ধরতেই সে সঙ্গে সঙ্গে ঘরে চলে এল। এই আগুনের মতো প্রয়াসের বিফলতার কথা চিন্তা করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বুকের ভেতর জমিয়ে ফেললাম।
আরো একদিন এমন হলো। আধারাতে উঠে দেখি সে বিছানায় নেই। বোনের ঘর, হেঁশেল, বাথরুম সবখানে তন্ন-তন্ন করে দেখি। আচমকা একটা সন্দেহের ছায়া মনের ভেতর দুলে উঠে। তবে কি- । কোথায় গেল সে?
নিঃশব্দে দরজা খুলে পেছনের পুকুরের দিকে যাই। দেখি সে ঘাটলার ওপর বসে। গলা দিয়ে বিনা প্রযত্নেই গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। তা’হলে প্রক্রিয়াটি এই অল্প সময়ের মধ্যে সে আত্মস্থ করে ফেলেছে। আকাশে থালার মতো একখানা চাঁদ জেগে। কুয়োতে গাছের বাকা নারকেল গাছের চিরল পাতাগুলো কাঁপছে। রাতের শিশিরে সিক্ত পাতাগুলো চাঁদের আলোর স্পর্শে চিকচিক জ্বলছে। এক ঝাঁক নক্ষত্র ফুলের মতো ফুটে আছে। প্রস্ফুটিত নক্ষত্রের ভারে প্রণত হয়ে পড়েছে আকাশ। শহর নীরব। মাঝে মাঝে মৃদু অতি মৃদু শব্দ শোনা যায়। মনে হয় গভীর ঘুমে চন্দ্রালোকিত নিশিরাতে পাশ ফিরে নিশ্বাস নিচ্ছে। এরই মধ্যে বাক্যপ্রার্থিনী রমণীর গলায় গোঁ গোঁ আওয়াজ রাতের ছন্দিত হৃৎপিণ্ডের মতো একটানা শব্দ করে যাচ্ছে। গোটা শহর মৃত-ঘুমন্ত । আমি গিয়ে সামনে হাজির হলাম। সে নজরও দিল না। আমিও যেন সারবন্দী নারকেল গাছের একটি। আপন মনে তার কাজ করে যায়। কি করে বুঝে গেছে তার এ কাজ আমি অপছন্দ করছিনে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটার পাশে গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। এক সময় আওয়াজ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এল। মনে হলো প্রবল বেগে চলার পর একটি পাম্পিং মেশিন থামল। ঘাটলার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কালা মাছের মতো শ্বাস টানল। আরো কিছুক্ষণ পর নিজেই আমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে এল। আমার বড় ভাল লাগল। এমনি করে বিস্ময় পরিস্ফুরিত দৃষ্টিতে প্রতিদিন স্ত্রীকে দেখছিলাম। প্রতিদিনই মনে হয় নতুন। যতই দেখি আশ মেটে না। ইচ্ছে হয় আরো দেখি- আরো ।
একদিন ছোট বোনটি স্কুল থেকে এসে বলল, জানো দাদা এক ব্যাপার হয়ে গেছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিরে? পয়লা সে মুখ টিপে হাসল। তারপর বলল, স্কুল থেকে ফিরে দেখি ভাবী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে। তারপর মুখে আঁচল দিয়ে হাসি চাপতে অদৃশ্য হয়ে গেল। বোনটিকে সেদিন বড় ফাজিল এবং নিষ্ঠুর মনে হল। কয়েকদিন পরই বাজারে রাষ্ট্র হয়ে গেল আমার বোবা বৌ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়। দাসী চাকরদেরও এ কথা বলাবলি করতে শুনলাম। লজ্জা শরমে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলাম। সে তো নিজে কথা বলে না, তাই লোকের কথায়ও তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমি তো কথা বলা সামাজিক জীব। লোকমুখের রটনা আমি অগ্রাহ্য করব কেমন করে! অথচ মুখ ফুটে কিছু বলব তার উপায় নেই। স্ত্রীর এই প্রচেষ্টাটি ছিল আমাদের দুজনেরই গোপন কঠিন সাধনা। সেটি প্রচার হয়ে গেছে। তাকে উলঙ্গ করে রাস্তায় ছেড়ে দিলেও বোধহয় এ রকম ব্যথা পেতাম না।
৭. দেশের পরিস্থিতি
দেশের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। যেখানে দেশের গভীর ব্যথা, মার্শাল সাহেবের গোমড়ামুখো সৈন্যেরা সেখানেই কাঁটা বসানো বুট জুতোর লাথি মারে। প্রথম প্রথম গোটা দেশ আঘাতের বেদনায় গুঙিয়ে উঠত। ক্ষত থেকে রক্ত বের হতো। আওয়াজে যন্ত্রণা ফুটে থাকত। প্রায় এক যুগ ধরে লাথি খেয়ে ব্যথা-জর্জর অংশ আঁটো হয়ে উঠেছে। এখন প্রতিবাদ করার জন্য মুখিয়ে উঠছে। যন্ত্রণা, বেদনা এবং দুঃখের কারখানা থেকেই প্রতিরোধের শাসানো আওয়াজ ফেটে ফেটে পড়ছে। তার ধার যেমন তীক্ষ্ণ, ভারও তেমনি প্রচণ্ড। সারাদেশে স্লোগানের ঢল নেমেছে। পথে-ঘাটে মানুষ- কেবল মানুষ। চন্দ্রকোটলের জোয়ারের জলের মতো বইছে মানুষ। বাংলাদেশের রাস্তাগুলো নদী হয়ে গেছে। তাদের চোখে আগুন, বুকে জ্বালা, কণ্ঠে আওয়াজ, হাতে লাঠি। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে স্লোগানের ধ্বনি বাংলাদেশের আকাশমণ্ডলের কোটি কোটি বর্শাফলার মতো ঝিকিমিকি খেলা করে।
শেখ মুজিব জেলে। আগরতলা মামলার বিচার চলছে। এখানে ওখানে বোমা ফুটছে, মিটিং চলছে। ঝাঁকে-ঝাঁকে মিছিল বেরিয়ে আসে। গুলি চলে। লাল তাজা খুনে শহরের রাজপথ রঞ্জিত হয়। সরকারী পত্রিকার অফিসগুলোতে হুতাশনের মতো প্রলয়করী অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। প্রতিটি সকালেই খবরের কাগজের পাতা উল্টোলেই টের পাওয়া যায় ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। গতিকটি সুবিধের নয় বলে মনে হলো। আইয়ুব খানের সিংহাসন ঝড়ে পাওয়া নায়ের মতো টলছে। শক্ত মানুষ ফিল্ড মার্শালের জন্য চিন্তিত হলাম। মার্শাল যদি যান আমার শ্বশুরও তো চিৎপটাং হবেন। যাদের করুণার বদৌলতে আমি পাড়া-গাঁয়ের ধূলিশয্যা থেকে এই বড় কর্তার আসনে উঠে এসেছি, তাঁরা সকলে যাবেন অথচ আমি একা থাকব সে কেমন করে হয়। শ্বশুরের জন্যে চিন্তিত হলাম। কথাটি পুরোপুরি সত্যি নয়। আসলে আমার মনেই দুশ্চিন্তা শত শত হুল ফোঁটাচ্ছিল।