অনিমেষবাবু মুখ খুললেন, আচ্ছা দানিয়েল সাহেব, একটা কথা বলুন তো। আমি শুনেছি শেখ মুজিব নাকি বলেছিলেন, বাংলাদেশে কমিউনিস্ট বিপ্লব ঠেকাতে হলে সবাইকে তার ওপর নির্ভর করতে হবে। কথাটা কতদূর সত্যি। বললাম, কথাটা আমিও শুনেছি। নিশ্চয়ই সত্যি হবে। তিনি বললেন, আমার অনুমানটা সত্যি হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হবে। বাংলাদেশ হয়তো স্বাধীনতা পাবে, কিন্তু কোন্ স্বাধীনতা? আখেরে জনগণের কোনো লাভ হবে না। দোদুল্যমান বিপথগামী নেতৃত্ব দেশের জনগণকে সম্পূর্ণ একটা অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। অর্চনা ট্রেতে করে চা নিয়ে এলো। সকলে চায়ের কাপ তুলে নিয়েছে, এই সময়ে অর্চনা কথা বললো, বাংলাদেশের কথা বাদ দাও। পশ্চিমবাংলার কথা চিন্তা করে দেখো। তোমাদের গলাকাটা এবং মূর্তিভাঙ্গা প্রোগ্রামটার কি হাল হয়েছে কখনো কি তলিয়ে দেখেছো? অনিমেষদা আমার তো ইচ্ছা হয়, তোমাদের সবাইকে একটা করে আয়না কিনে দেই। যাতে করে নিজেদের চেহারা নিজেরা ভালো করে দেখতে পারো। দিনে দিনে যে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে পশ্চিমবাংলায়ও কি শ্বাস নিতে কষ্ট হয় না? ভুল শুধু বাংলাদেশের নেতারা করেছে আর তোমরা করোনি, এটা কি সত্যি?
সত্যব্রতবাবু বললেন, বাংলাদেশ সেন্টিমেন্ট এক্সপ্লয়েট করে শাসক কংগ্রেস এখানকার পরিস্থিতি এমন ঘোলাটে করে তুলেছে যে সত্যিকার বিপ্লবীদের চেহারা দেখানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ঠং করে পেয়ালাটা পিরিচের ওপর রেখে অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, সত্যব্রত তুমি সত্যিকার বিপ্লবী কাদের বলছো! যারা মূর্তি ভেঙ্গেছে, গ্রাম গঞ্জের জোতদার মহাজনের গলা কেটেছে, চীনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান বলেছে, তারাই কি সত্যিকারের বিপ্লবী? আজকে তোমরা বাংলাদেশের ছেলেদের দায়ী করছো। তোমাদের বন্ধুরা কি অবগত আছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার জন্য তাঁরা কম দায়ী নন। পশ্চিমবাংলার বিপ্লবী আন্দোলন বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলো একটা সময় পর্যন্ত জাতীয় সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি। তোমাদের নেতাদের মতো তারাও বলেছে চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান! যেহেতু পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব আছে তাই বামপন্থী কতিপয় দল এখনো পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আসতে তোমাদের ভ্রান্তনীতি কি সহায়তা করেনি? আগে নিজেদের দোষগুলো দেখো তারপর বাংলাদেশের দোষ ধরতে যেয়ো। দুঃখ এই জায়গায় যে কেউ সহজ বিষয় সহজভাবে দেখছে না।
বাহ্ চমৎকার আড্ডা হচ্ছে দেখছি। সুনীলদা ঘরে ঢুকলেন। দরোজা খোলাই ছিলো। তিনি অর্চনার বড় ভাই। একটি বিদেশী কোম্পানীতে এক্সিকিউটিবের চাকরি করেন। সব সময়ে হাসিখুশি থাকার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে সুনীলদার । তিনি ঘরে ঢুকতেই মনে হলো, দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিয়েছে কেউ। অনিমেষ, সত্যব্রত, দানিয়েল সবাই একসঙ্গে, বাহ্ চমৎকার। তিনি হাতের ব্যাগটা রেখে এক সঙ্গে বসে গেলেন। কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো তোমাদের। অর্চনা বললো, দাদা তুমি তো অফিস থেকে এই মাত্র এলে। কাপড়চোপড় বদলে মুখহাত ধুয়ে তারপর বসো না। এখনতো তুমি ক্লান্ত। আরে রাখো, ক্লান্ত হবো কেননা । আমার নার্ভের মধ্যে জীবনযাপনের ঝকমারী ছাড়া অন্য কোনো ট্যানশন নেই। তাই আমি ক্লান্ত হইনে। তোদের মতো অতো পঁাচগোচ তো আমি বুঝিনে। আমার ওই একটাই কথা, যে কেউ নিজের শরীরের চাইতে বড় কোনো কিছুর জন্য আত্মদান করবে, যতো ভুলই করুক, আলবত একটা ফলবে। এই ধরো না বাংলাদেশের কথা, সেখানে এতো মানুষ প্রাণ দিচ্ছে তার একটা সুফল আসবেই। আবার ধরো শয়ে শয়ে নকশাল ছেলে সিআরপি এবং পুলিশের হাতে প্রতিদিন খুন হচ্ছে তারও একটা ফল হবে। হয়তো তুমি আমি যেভাবেই চাই সেভাবে হবে না, কিন্তু ফল একটা অবশ্যই হবে। সত্যব্রতবাবু বললেন, সুনীলদা আপনার একটা সুবিধে কি জানেন? আপনি সমস্ত জাগতিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব আকাশে টেনে নিয়ে একটা সমাধান টেনে আনতে পারেন। এ ব্যাপারে আপনি হেগেলেরও এক কাঠি ওপরে। পরম সত্তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সমস্ত জাগতিক দ্বন্দ্বের অবসান করে ফেলতে পারেন। সুনীলদা বললেন, তোমার ওই হেগেল টেগেল বুঝিনে। আমি অত্যন্ত সহজ মানুষ এবং সাদা চোখে দুনিয়াটা দেখি। সুনীলদা অন্য রকমের মানুষ। উনাদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি বেমানান এ কথাটা দু’পক্ষই বুঝতে পারে। তাই সত্যব্রতবাবু বললেন, চলুন অনিমেষদা যাই। সুনীলদা বললেন, সে কি তোমরা এরই মধ্যে চলে যাবে? তা কেমন করে হয়। বসো গল্প করি। চা খাও। অনিমেষ বাবু বললেন, চা খেয়েছি। আরেকদিন না হয় আসবো আজ চলি। সুনীলদা বললেন, রোববার ছুটির দিন আছে, সকাল বেলা এসো, চুটিয়ে গল্প করা যাবে।
উনারা দু’জন চলে গেলে সুনীলদা আমার কাছে ঘেঁষে বসলেন। ধরো দানিয়েল, তোমাকে একটা ভালো সিগারেট দেই। টেনে দেখো যদি ভালো লাগে আস্ত একটি প্যাকেটই প্রেজেন্ট করবো। আজ এক পার্টি আমাকে আস্ত একটা কার্টুন গিট করেছে। তিনি সিগারেটে টান দিয়ে আরাম করে ধোয়া ছেড়ে বললেন, দুনিয়াতে বিস্তর ভালো জিনিস আছে, মাঝে মাঝে চেখে না দেখলে জীবনটাই বিস্বাদ হয়ে যায় বুঝলে দানিয়েল। তারপর তিনি জুতো জোড়া এবং গায়ের জামাটি খুলে টেবিলের ওপর পা দুটি তুলে দিয়ে বললেন, কিছু মনে করো না দানিয়েল। ইচ্ছে হলে তুমিও তুলে দাও। এখন বলো তোমার যুদ্ধের সংবাদ। আমি বললাম, চলছে। সুনীলদা আসলে কথা বলার একটা উপলক্ষ চাইছিলেন। তারপর বলতে থাকলেন। দেখবে একদিন তোমাদের জয় হবেই। এ তোমাদের ন্যায়যুদ্ধ। জানো তাৈ, যথা ধর্ম তথা। জয়। ধর্ম তোমাদের পক্ষে। একদিন আমি তোমাকে বিজয়দার কাছে নিয়ে যাবো। এসব কথা তিনি আমার চাইতে আরো ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবেন। বিজয়দা এখন রামকৃষ্ণ মিশনে থাকেন। মনে করো না, তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে ডুবে থাকেন। মোটেই সত্যি নয়। দেখবে কি রকম বিচক্ষণ মানুষ। জগৎ-সংসারের সব খবর রাখেন। আধুনিক ফিজিক্সের জটিল সব তত্ত্ব ক্যাট মানে বেড়ালের মতো করে বুঝিয়ে দিতে পারেন। দেখে বিশ্বাসই হবে না এই মানুষটি যৌবনে বাঘা যতীনের সঙ্গে বালেশ্বরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বললেন, মানুষের মনের এই যে ট্যানশন তার পেছনে দু’টি কারণ, একটি হলো লোভ, অন্যটি অনিশ্চয়তা। মনের ভেতর থেকে এই দু’বস্তুর অবসান ঘটাতে পারলে দেখবে জীবন অনেক ফলবান এবং পৃথিবী অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে। সুনীলদার বক্তৃতাটি আরো দীর্ঘ হতে পারতো। কাজের মেয়েটি খবর দিয়ে গেলো, কে একজন তাঁকে টেলিফোনে ডাকছে। আমি বললাম, সুনীলদা আজ আমার একটু কাজ আছে, সুতরাং চলি। আরেকদিন না হয় আসবো। তিনি জোর করলেন না।