অন্য কিছু বল।
আর কী বিশেষণ দিতে পারি?
যা খুশি।
তোমাকে একটা বিশেষণে ডাকব বলে অনেকদিন ভেবেছি। কিন্তু পারিনি। ভয় করেছে।
ভয় করলে থাক। তেমন বিশেষণে আমার দরকার নেই।
তুমি অভয় দিলে—
তুমি পুরুষ নও অনিল। তোমাদের ভিতর তুমি সবচেয়ে স্মার্ট, তার যদি এমন অবস্থা হয় তবে পুরুষ জাতটার ওপর আর বিশ্বাস রাখি কী করে?
তুমি অভয় দিলে আমি বলতাম।
যাক। যা বলছিলাম। তুমি বলে যাও, আমি নোট করে নিচ্ছি। ঐ দ্যাখো, এন. কে. জি. যাচ্ছেন। চুপচাপ মুখোমুখি বসে থাকতে দেখলেই বলবেন, দুপুরবেলায় টাওয়ারের মাথায় আজকাল চাঁদ ওঠে নাকি সোমা?
অনিলের মুখটা ভীষণ লাল দেখাচ্ছিল সেদিন।
আর সোমার কী হাসি পাচ্ছিল। সে মাথায় আঁচল তুলে বলল, অনিল, আমাদের বাড়ি এসো একদিন। তুমি যা ভাবছ সেটা সুবিধামতো ভেবে দেখা যাবে। এখন নোট নিচ্ছি, নোট নিতে দাও।
সে নোট নিতে নিতে অনিলের মুখ চুরি করে দেখছিল। আহা বেচারা, দুঃখে আর তাকাচ্ছে না। কেবল খাতায় মুখ রেখে বলে যাচ্ছে। ভয়ে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। তাকালেই বুঝি সোমা হেসে ফেলে। সে অপমান বোধ করবে আবার! অথচ সোমার শরীরে কী যে আকর্ষণ, উঁচু লম্বা সোমার চোখে কাজল থাকে না। কাজল দিলে এই যুবতীর চোখে এক অকারণ বিষণ্ণতা ভেসে ওঠে।
সোমা পাশ ফিরে আবার মনীষের দিকে তাকাল। ওর শরীর থেকে চাদর সরে গেছে। সে উঠে গিয়ে পাশে বসল এবং শরীরের চাদরটা তুলে দিতেই খপ করে ধরে ফেলল মনীষ।
তুমি ঘুমোওনি তবে?
না, আমার ঘুম আসছে না।
তোমার ঘুম না আসার কী হল?
তুমি তো জান আমার কেন ঘুম আসে না।
আমি আজ আর পারব না বাপু।
লক্ষ্মীমেয়ে। একটু পাশে শোও।
লক্ষ্মীছেলে। এমন করে না। দুষ্টুমি আমার এখন ভালো লাগবে না!
মনীষ উঠে বসল। সাপ্টে ওকে কোলের উপর ফেলে দিয়ে চুমু খেল। ভীষণ খারাপ লাগছে সোমা। আমি পারছি না।
সোমা বলল, ছাড় তো আগে।
মনীষ ছেড়ে দিল।
সোমা জানলা খুলে দিল। কেমন গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী থেকে যাবতীয় শীত কারা চুরি করে নিয়ে গেছে। সে এতটুকু ঠান্ডা বোধ করছে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কেন জানি মনীষকে পর্যন্ত ভয় পেতে শুরু করেছে।
নিচে লন। সবুজ ঘাস। কিছু লাল গোলাপ। দামি ফ্লোরেসেন্ট বাতি গোলাপের ভিতর। ছোট ছোট টিনের ফ্রেমে সেই আলো জাফরি কাটা। চারপাশে কী সমারোহ বাঁচার। আর একটু দূরে গেলেই ফুটপাথে অজস্র মানুষ, শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। গরিব, খেতে না পাওয়া হাজার হাজার মানুষের মুখ যেন চুপি চুপি পাঁচিলের পাশে এসে জড়ো হয়েছে এবং রাতে যখন সে ঘুম যাবে, সদরে কেউ থাকবে না, সোমা দত্ত ঘুম যাবে, তখন অতর্কিতে আক্রমণ ঘটবে। এইসব অন্নহীন মানুষের ভিতর সেই মানুষের মুখটাও উঁকি দিয়ে আছে দেখতে পেল। তাকে ওরা এ—বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
সোমা কেমন অতর্কিতে হাহাকার করে উঠল—মনীষ মনীষ!
মনীষ ছুটে বের হয়ে গেল? কী হয়েছে! এমন করছ কেন?
সোমা কেমন বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সে দেখল শুধু গোলাপ, বড় বড় লাল গোলাপ, শুধু আলো, চারপাশে আলো আর আলো, এই আলো, ফুল এবং নক্ষত্র দেখে কেমন তার বুক কেঁপে উঠেছিল। আর কিছু নেই। মনীষ বারবার ওকে বলেও কিছু জানতে পারছে না।—তোমার যে কী হয়েছে সোমা!
সোমা বলল, আমি জল খাব।
মনীষ টিপয় থেকে কাচের মীনা—করা গেলাস এনে সামনে ধরল।
সে যেবার জার্মানিতে ব্যবসা—সংক্রান্ত টুরে গিয়েছিল, এবং যাদের কলাবরেশনে সে মধ্যমগ্রামের কাছে একটা দুর্লভ কাচের কারবার করবে ভেবেছিল, তাদের উপহার দেওয়া এই গেলাস। দামি। কত দামি মনীষেরও জানা নেই। সোমা এই গেলাসেই জল খেতে পছন্দ করে। সে বলল, আরও জল খাব? এনে দেব?
গেলাসটা দেবার সময় সোমা বলল, না আর লাগবে না।
তুমি আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। ভিতরে এসো।
তুমি যাও, আমি যাচ্ছি।
আমাকে তুমি এভাবে ডাকলে কেন?
তোমাকে ডেকেছি!
ডাকলে না?
হঠাৎ কী যে হল।
মনীষ মাঝে মাঝে সোমার কিছু স্নায়বিক দুর্বলতা লক্ষ্য করেছে। ওর ডাক্তার বন্ধুর অভাব নেই। সে কাউকে এ—ব্যাপারে খুব কিছু একটা খুলে বলেনি। বললেই ওর অতীত নিয়ে আলোচনা হবে। এবং অতীতে সোমা কোনো ভয়াবহ কাজে লিপ্ত ছিল কী না, শিশুকালে কোনো অপমৃত্যু দেখেছে কী না, অথবা সে এমন কোনো পাপ কাজের সঙ্গে নিযুক্ত ছিল যা এখন তাকে মাঝে মাঝে অস্থির করে তুলছে।
মনীষ এও জানে বেশি সময় সোমার এটা থাকে না। সে সেজন্য আজ আর কোনো দৈহিক সম্পর্কের কথা ভাবল না। সে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আমি কিছু করব না। ভয় করলে তুমি আমার পাশে শোও। ছুঁয়ে বলছি তোমাকে ডিস্টার্ব করব না। আমার পাশে শুলেই তুমি ঘুম যেতে পারবে।
সোমা হাসল। বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি মনীষ। বিশ্বাস করি বলেই তোমাকে বিয়ের আগেই সব দিয়ে ফেলেছিলাম। কেউ দেয়? বল, মেয়েদের এইটাই তো অহঙ্কার?
মনীষ এমন কথায় আপ্লুত না হয়ে পারল না। সে বলল, এসো সোমা, আমার পাশে শোবে। বলে মনীষ নিজেই দুটো খাট টেনে একসঙ্গে করে নিল। বিছানা বড় করে ফেলল। বালিশ পাশাপাশি রেখে দিল। সোমা নরম বালিশে ঘুম যেতে পারে না। ওর শক্ত বালিশ লাগে। সোমা শোবার আগে আঁট করে খোঁপা বাঁধে। সাদা রঙের সিল্কের গাউন। নানারকম লাল সবুজ সুতোর লতাপাতা আঁকা। ফুলের ওপর প্রজাপতি আঁকা। কোনো কোনো দিন সে খুব কালো রঙের গাউনও পরে। ওর সাদা পা তখন মোমের মতো নরম লাগে। যেন একটু তাপ লাগলেই গলে যাবে। এত নরম আর উষ্ণ যে সে ভয়ে তখন ওকে আলিঙ্গন করতে পারে না। জোরে চাপ দিতে পারে না। হুড়মুড় করে হাড়—পাঁজরা বুঝি তার সব ভেঙে যাবে।