সোমার রাতে ঘুম আসছিল না। দরজা—জানালা বন্ধ। মনীষ পাশের খাটে ঘুমোচ্ছে। ওর এখন বাইরের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। সদর বন্ধ। লম্বা করিডোর পার হয়ে গেলে মনোরমার ঘর, সিঁড়ির নিচের ঘরে রসুল থাকে। রসুল মনীষের খাস বেয়ারা। সোমা অথবা রসুল একজন না একজন মনীষের সঙ্গে থাকে। যখন ওরা দূরে বেড়াতে যায় তখন রসুল ওদের পাহারাদার। বড় বিশ্বস্ত রসুল।
সোমার কেন যে ভয় ভয় করছিল! সে মানুষটা তার বাড়ি চিনে যদি চলে আসে। রসুল ওকে চেনে না, রসুল ওকে ঢুকতে দেবে না। সে রসুলকে যদি বলে আমি সোমার সঙ্গে দেখা করব, রসুল এমন একজন চেহারার মানুষকে কিছুতেই ফেরাতে পারবে না। সে এসে বলবে কে একজন এসেছেন মা, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। সোমা পায়ে তখন আলতা পরবে। চোখে কাজল। বিনুর বড় ইচ্ছা ছিল কাজল টেনে চোখে বিনুর সঙ্গে সে কোথাও বেড়াতে যায়। সোমা পাশ ফিরে শোবার সময় এমন ভাবল।
ওর কষ্ট হচ্ছিল মনীষের কথা ভেবে। বেচারা সত্যি ভয় পেয়ে গেছে। ভয় পেলে ঘুমোয় কী করে। সে কি ঘুমোচ্ছে, না চুপচাপ শুয়ে আছে? নড়ছে না। ওর ইচ্ছা হচ্ছিল উঠে একবার দেখে—সে ঘুমোচ্ছে কিনা। না ঘুমোলে সে আজ আবার সারারাত ওকে পাশে বসিয়ে রেকর্ড—প্লেয়ার চালিয়ে দেবে। কিছু ইংরেজি গান মনীষের পছন্দ। কিছু ইংরেজি সাহিত্য ওর প্রিয়। এবং ওথেলো নাটকের কিছু সংলাপ। যখন মনীষ অত্যধিক মদ্যপান করে ফেলে তখন মনীষ সোমাকে জড়িয়ে কিছু অবিশ্বাসের সংলাপ একের পর এক বলে যায়। সোমা তখন খিলখিল করে হাসে।
কে সেই মানুষ! মনীষের চিরদিন একটা অবিশ্বাস। সোমা এত বেশি সুন্দর যে ওর বিশ্বাস সোমা কবে যে নদীর পারে চলে যাবে। সে ভয়ে ভয়ে থাকে। সোমাকে তার সব ঐশ্বর্য দেবার জন্য সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। সোমার আজকাল কোনো শৈলশহরে বাড়ি কেনার ইচ্ছা। বাড়িটা সাদা রঙের হবে। সদরে দারোয়ান। এবং দারোয়ানের চোখ—মুখ একটা কাফ্রির মতো। কানে বড় বড় রিং। হাতে বল্লম নিয়ে সে পাথরের মতো সদরে বসে থাকবে। প্রায় জল্লাদের মতো চেহারা। নীচে অজস্র গ্রাম্য কুটির। সেখানে শীতের রাতে আগুন জ্বেলে পাহাড়ি মানুষেরা যে মাংস পুড়িয়ে খাবে সোমা পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে তা দেখবে। অথবা রাতে সোমা এবং সে ওথেলো নাটকের সংলাপ আবৃত্তি করতে করতে সামান্য মদ, নরম চিলি চিকেন, মৃদু আলো, আকাশ ভরা নক্ষত্র উপভোগ করবে। এত করেও পাশ ফিরে শুলে সেই মুখ—অপলক তাকে দেখছে। যেন বলছে সোমা তোমার তো এমন হওয়ার কথা ছিল না।
আমার কী হওয়ার কথা ছিল?
তুমি ভুলে গেছ তা?
কে এমন মানুষ যাকে বলে এসেছে সে অন্যরকমের হবে? সে তার কলেজ জীবনের কথা মনে করার চেষ্টা করল। এই যেমন রমেন আর অনিল। ওদের একজন কি সে! সে ভালো করে ওদের মুখ—চোখ পর পর ভেবে গেল। সাত—আট বছরে সে ওদের ভুলে যাবে? ওদের এত বেশি পরিবর্তন আসবে? ঠিক চিনতে পারেনি বলে ওকে দূর থেকে দেখেছে। ওর চোখের ওপর ওরা মিছিলের মতো ভেসে গেল। রমেন কালো, বেঁটে। চুল ওর ব্যাকব্রাশ করা। চোখ ছোট। মানুষটার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। আর একজন উঁচু, লম্বা, নাক চ্যাপটা, থুতনিতে ভাঁজ, চুল শ্যাম্পু করা সব সময়—সে তো অমিয়। ওদের ভিতর অনিল স্মার্ট। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। কিন্তু চোখে—মুখে বড় বেশি স্বার্থপর সে। তবু অনিলকে সোমার ভালো লাগত।
সে তার অনার্সের অনেক নোট অনিলের কাছে নিয়েছে। কলেজের শেষ প্রান্তে যেখানে জেলখানার পাঁচিল আরম্ভ হয়েছে, যেখানে সার মণীন্দ্র নন্দী, কে. সি. আই—এর স্ট্যাচু আছে তার নিচে বসে ওরা দুজন প্রায়ই গল্প করত। কিছু কিছু সংলাপ সে এখনও মনে করতে পারে। যেমন অনিল প্রায়ই বলত, তুমি সাঁতার জানো সোমা?
কেন জানব না।
অনেক মেয়ে সাঁতার জানে না।
তুমি অনেক মেয়ের মতো আমাকে ভাবলে কী করে?
তুমি তা হলে আলাদা?
আমার তাই মনে হয়।
মেয়েরা কখনো আলাদা হয় না।
কেন হয় না?
ওদের ঈশ্বর গড়েছেন একভাবে।
তুমি ঈশ্বর—টিশ্বর মানো দেখছি।
তুমি মানো না?
না, আমার মানতে ভালো লাগে না।
কেন লাগে না?
এই ঈশ্বরই প্রথম মানুষকে মিথ্যাকথা বলতে শিখিয়েছে বলে।
কী বলছ সোমা?
ঠিক বলছি। এই যেমন ধর ঈশ্বর যে বলেছেন আমি ঈশ্বর—
ঈশ্বর কখনো এমন কথা বলেন?
তবে মানুষ বলছে—ঐ দ্যাখো ওপরে ঈশ্বর আছেন।
মানুষ বলেছে বলতে পারো।
মানুষ কি ঈশ্বর দেখেছে?
মানুষ কল্পনা করেছে।
সোমা মাঝে মাঝে রেগে উঠলে বেশি, আঁচলটা মাথার ওপর টেনে দিত। তারপর খুব যেন ভেবে উত্তর দিচ্ছে, তা হল দেখো সেই কল্পনাটাকেই সত্য ভেবে আমরা কী না করছি। আমরা মন্দিরে মসজিদে মাথা ঠুকছি। ঈশ্বর নিজেই প্রথম মিথ্যার বেসাতি খুলে মানুষকে ভড়কে দিয়েছে।
অনিল চুপ করে থাকত। সে এসব তর্ক পছন্দ করে না। সে হালকা তর্ক করতে চায়। কিন্তু যা মেয়ে সোমা, তাকে এত সহজে ছেড়ে দেবে না। সে বলত, তুমি বলতে চাও, যার কোনো মূল অস্তিত্ব নেই তাকে নিয়ে আমরা মন্দির মসজিদ বানিয়ে নিরুপায় মানুষকে ভয় দেখাচ্ছি?
তা ছাড়া আর কী।
দ্যাখো সোমা, আমরা এ—সব তত্ত্বকথা এখনও তেমন বুঝি না। আমাদের সে বয়স হয়নি। এত সহজে কিছু নস্যাৎ করা ঠিক না।
আমি করতে পারি।
তুমি তবে রাজমহিষী।