মনীষ যখন বাথরুম থেকে ফিরে এল তখন সে দেখল ঘড়িতে দশটা বাজে। মনোরমা বাইরের বারান্দায় পায়চারি করছে। পার্লারে সে নতুন একটা লাল রঙের কার্পেট বিছিয়েছে কিছুদিন আগে। সেই কার্পেটে কত বিচিত্র সব ফুলের ছবি। ছবিতে কত রঙ—বেরঙের প্রজাপতি। মনোরমা গরম কফি রেখে গেছে। সে একটা চুরুট ধরিয়েছে, কফি খেতে খেতে অফিসের কিছু ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। সে এক বিষাদ কুড়িয়ে এনেছে সঙ্গে এবং এই বিষাদে তাকে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে, কেন যে সোমা এমন রহস্যময় মুখের কাছে ধরা পড়ে গেল বুঝতে পারছে না। আর পারছে না সে। সে এবার সোমা বাথরুম থেকে বের হয়ে এলেই বলবে, তুমি ওকে চেন সোমা? তোমার সঙ্গে ওর কবে আলাপ?
মনোরমা বলল, দাদাবাবু আপনার খাবার ঠিক করব?
মনীষ বলল, সোমা আসুক।
দশটা বাজলে ওরা খেয়ে নেয়। দশটা বেজে গেছে বলেই মনোরমা ওদের খাবার টেবিল সাজাবে কিনা জিজ্ঞাসা করল। সোমা এমন কতদিন এসেই বলে দেয়, আমরা কিছু খাব না, খেয়ে এসেছি। যেন সোমা বাইরে থেকে এসে কতক্ষণে শরীর মুছে ধুয়ে অথবা স্নান করে তার সেই প্রিয় রেকর্ড—প্লেয়ার খুলে গান শুনবে। ওর প্রিয় গান সব থাকে সাজানো। অনেকদিন সে আলো জ্বেলে শুয়ে থাকে। রেকর্ডপ্লেয়ারে তখন বাজছে ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে, উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে’। মনীষ তখন দেখতে পায় একটা নীলরঙের আলোর নিচে সোমা সিল্কের গাউন পরে শুয়ে আছে। সাদা রঙের বিছানায় ঠিক একটা পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে মনে হয়। সে এসে ধীরে ধীরে কখনো ডেকে দেয়। সোমা এসো খাবে। কোনো কোনো রাতে সোমা আপন মনে জানালায় দাঁড়িয়ে গায়। তখন অজস্র নক্ষত্র আকাশে। কেমন অসুখী মনে হয়। মনের ভিতর ওর যে কী কষ্টের ছায়া পড়েছে ক্রমে সে বুঝতে পারছে না।
আজও মনে হল বাথরুম থেকে বের হয়ে সে চুপচাপ বসে থাকবে। অথবা আপন মনে সে গাইবে ওর সেই প্রিয় গানটা—গোলাপফুল ফুটিয়ে আছে, মধুপ হোথা যাসনে, ফুলের মধু লুটিতে গিয়ে কাঁটার ঘা খাসনে। মাঝে মাঝে গাইতে গাইতে চোখ থেকে জল পড়ে সোমার। অথচ কখনো কখনো সে সোমাকে নিয়ে যখন গাড়ি করে বের হয়ে যায়, কোনো পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে হাত ধরাধরি করে অথবা পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে যায়, অনেক ওপরে, কেন যে মনে হয় তখন এই পৃথিবীতে সে আর সোমা, সোমা বিহনে সে নদীর পাড়ে একা পড়ে থাকবে—কেবল যেন গাইবার ইচ্ছা, ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে, শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি, ওগো সুন্দরী। চাও কী প্রেমের চরম মূল্য দেব আনি, দেব আনি, ওগো সুন্দরী। সে সোমার হাত ধরে পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। চারপাশে উপত্যকাময় অজস্র ফুলের ওপর বাতাস বয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোথায় কোন ম্লান অন্ধকার চুপ করে প্রতীক্ষা করছে মনে থাকে না। সে তখন সোমাকে নিয়ে কতদূরে চলে যেতে পারে। তার ভয় থাকে না। অথচ আজ কী যে ভয় তাকে পেয়ে বসেছে!
সোমা স্নান করে এসে এতটুকু শীতে কাঁপল না। ঘরের ভিতর এখন উষ্ণ আবহাওয়া। বড় পবিত্র চোখ—মুখ তার। এয়ার কন্ডিশান মেশিনটা কেমন একটা থেকে থেকে ক্লপ ক্লপ শব্দ করছে। আমার খেলা যখন ছিল তোমার মনে, ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত, যেন আমার আপন সখার মতো—সোমা গুনগুন করে গাইতে থাকল—তখন কে তুমি কে জানত, ওগো সেদিন তুমি গাইলে যে—সব গান, কোন অর্থ তাহার কে জানত শুধু সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ, সদ্য নাচত হৃদয় অশান্ত। হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি, স্তব্ধ আকাশ নীরব শশী রবি, তোমার চরণ পানে নয়ন করি নত, ভুবন দাঁড়িয়ে আছে একান্ত, খেলা যখন ছিল তোমার সনে….। সোমা মাথা নিচু করে রেখেছে। এবং নিভৃতে গেয়ে চলেছে। মনীষ গান শেষ হলে ডাকল, সোমা।
গানটা শেষ করার পরও তার ভিতরে গানের রেশ থাকছে। সে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে পারল না।
মনীষ কাছে এসে বসল। ওর ঠান্ডা হাত তুলে ডাকল, তুমি ওকে চিনতে?
সোমা কিছু বলল না। মনীষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
আমি দেখেছি সোমা, তুমি ওকে চুরি করে দেখছিলে, তুমি কি চেন ওকে?
সোমা ঘাড় নাড়ল। না। সে চিনতে পারছে না এমন বলতে চাইল।
তবে সে তোমার দিকে এমন তাকাচ্ছিল কেন?
জানি না।
তুমি কিছু জান না সোমা?
না, কিছু জানি না।
কিন্তু তোমাদের মুখ দেখে মনে হয়েছে যেন কতকালের জানা—চেনা।
ওর চোখ দেখে আমারও তাই মনে হয়েছে। কতকালের যেন সে চেনা—জানা।
সোমার এই মুখ দেখলে কে বলবে, কিছুক্ষণ আগে কফি হাউসে বসে সোমা ঠাট্টা—মসকরা করেছে, সে ওকে দেখতে দেখতেও ঠাট্টা—মসকরা করেছে। কিন্তু সোমা যখন উঠে আসছিল, সোমা যখন দেখছিল—তখনও মানুষটা তাকে দেখছে এবং কাছে যেতেই কী যে মনে হল তার, সোমা কেমন নিভৃতে চলে গেল। অন্ধকারের অন্তরে সে বারবার তাকে সাড়া দিচ্ছে। সে আর কথা বলতে পারল না। চুপচাপ সিঁড়ি ধরে নেমে এসেছিল। আমি আবার আসব। সোমার চোখে—মুখে এমন আভাস যেন।
মনীষ এ সময় আর ওকে এসব বলে বিব্রত করতে চাইল না। তুমি বরং খেয়ে নাও।
তুমি না খেলে ভালো লাগে?
মনীষের অনুরোধে সে টেবিলে বসল মাত্র। সে খুব যত্নের সঙ্গে মনীষকে পরিবেশন করল। শুধু এটা ওটা নিয়ে সে চেখে দেখল। দেখতে দেখতে বলল, মনীষ, কাল তুমি অফিস যেয়ো না। আমি একা থাকলে মরে যাব, আমার কেমন ভয় করছে।