যেমন সে একবার সব বন্ধুদের নিয়ে ম্যাড হাউসে গিয়েছিল। অশোক এমন একটা চালিয়াতি মার্কা জীবনযাপন করত এবং আড্ডার টেবিলে তার এমন ব্যাখ্যা রাখত যে মনে হত মাঝে মাঝে এ—সব না করলে, যেমন একটু মদ্যপান, পালিয়ে চুমু খাওয়া ভালোবাসার মেয়েকে এবং রঙিন কোনো ছায়াছবিতে একপাশে সব শেষের রো—তে বসে ফষ্টিনষ্টি, একটু হাত দেওয়ার ব্যাপার না থাকলে প্রেম—ফেমের মূল্য কী। মনীষ সে সব বিয়ের আগেই সোমাকে নিয়ে করেছে। সোমার এতে সায় ছিল। এবং এত বেশি সায় ছিল যে সে কথায় কথায় মাঝে মাঝেই রঙিন ছবিতে একটা মুরগি—মোরগা পাছা তুলে নাচছে এমন দেখতে পেত। সবচেয়ে সেই ছবি যেখানে নায়িকা মুরগি বনে গেছে এবং কক কক করে ডাকছে—অ মোরগা।
মোরগ—মুরগির লড়াইতে সোমা কম যায় না। নাচে ভালো। সব ভালো তার। তবু আজ কেন জানি সোমার চোখে চুরি করে অন্য ঘরে উঁকি দেওয়া ভালো লাগল না। সে ভাবল সোমা যখন একা শুয়ে থাকবে, নীল মৃদু আলো জ্বালিয়ে শিয়রে, সে যখন রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে রেকর্ড—প্লেয়ারে এবং অবিকল নকল করে সেই গান গাইবে তখন তার পাশে বসে কোমল, উষ্ণ উত্তাপের ভিতর হাত রাখতে রাখতে বলবে, সে কে সোমা? তুমি চুরি করে কাকে দেখছিলে?
মনীষ চুপচাপ আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকল। মনোরমা এসে দরজা খুলে দিচ্ছে। সে জেগে থাকে। যতক্ষণ না বাবু—বিবি বাড়ি ফিরে আসে ততক্ষণ সে জেগে থাকে। ওদের ফিরতে কোনো কোনোদিন বেশ রাত হয়ে যায়। বোধহয় পার্টি থাকে। পার্টিতে কতরকমের খাবার। সোমা অথবা মনীষের আজকাল সেসব অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে রোজ রোজ ভালো লাগে না। মাসে দু—একবার হলে মন্দ নয় এমন ভাব। সে বেশি কিছু খায় না। দু—পেগ জিন, ওর ওতেই ম্যাকসিমাম। মনীষ আজকাল যেদিন খায় চার—পাঁচ পেগ অনায়াসে টেনে আসতে পারে। মনীষকে ছোটখাট একটা ব্যবসা চালাতে হয়। তার বড়মামা ব্যবসায় ফন্দিটা শিখিয়ে দিয়েছে। এবং সে তার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কত সহজে এ তিন—চার বছরে দশগুণ করে ফেলেছে। এবং ওর ধারণা সোমা লক্ষ্মীমেয়ে। সে না এলে লক্ষ্মী তার ঘরে এমন দশভুজা হয়ে আসত না। তার চারপাশে আজকাল মাঝে মাঝে ঝমঝম করে টাকার বৃষ্টি নামে। সে তখন ভেবে পায় না এই শহরে এত ঐশ্বর্য আর এসব মানুষেরা কেন ফুটপাথে থাকে? আসলে ওর মনে হয় তখন, এদের বড় বেশি উদ্যমের অভাব।
সোমা ঘরে ঢুকেই কেমন সোফাতে গা এলিয়ে দিল। এখন মনোরমা আসবে। এসেই জিজ্ঞাসা করবে খাবার গরম করে দেবে কিনা। কারণ খাবার কোনো কোনো দিন ঠান্ডা হয়ে যায়। সোমার নিজেরই ঠিক থাকে না কখন ফিরবে। যেমন আজই ধরা যাক ওদের কথা ছিল ছবি দেখে সোজা বাড়ি চলে আসবে। কোথাও বসবে না। কিন্তু আটকে গেল। এমন কথা ছিল না। এ—স্বভাবটা মনীষেরও আছে সেই প্রথম জীবনের কিছু ঠিকঠাক না থাকার মতো।
সোমা মনোরমাকে দেখেই বলল, আমরা আজ বেশি কিছু খাব না। খেয়ে এসেছি।
মনীষ সোজা বাথরুমে ঢুকে গেছিল। ওর বাইরে কোথাও বাথরুমের দরকার হলে খুব অসুবিধা হয়। ওর নিজের জন্য আলাদা বাথরুম। বাথরুমের চারপাশে বড় আয়না। পাশের বাথরুম সোমার। সোমার বাথরুমেও চারপাশে বড় আয়না আছে। ওদের শোবার ঘরে চারপাশে বড় আয়না। সাধারণত সে ঘরে কোনো আত্মীয়স্বজনের ঢোকার নিয়ম নেই। মনোরমা দিনে দুবার ঢুকতে পারে। একবার সকালে। আর একবার বিকেলে। পৃথিবীর যাবতীয় ন্যুড ছবি ঘরে। দেওয়ালে কোণারকের ডিজাইন। সে এ—ঘরটা নিজের পছন্দমতো তৈরি করেছে। সঙ্গে এ—ঘরেও আলাদা আলাদা দুটো বাথরুম। সেজন্য বাইরে কোথাও বাথরুম ব্যবহার করতে পারে না। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই ওদের বাথরুমে যাবার স্বভাব। অথচ আজ বাথরুমে ঢুকেই সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। নীলবর্ণের একটা আলো জ্বেলে দিল। সে কেন যে এভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকছে, সে কি এখনও সেই রহস্যজনক মুখের কথা ভাবছে? এবং ভিতরে একটা হিংসা, ক্রোধ। অথবা সে কি নিজেকে কোনো অপরিণামদর্শী যুবক ভাবছে? কিছু করণীয় নেই, সব ভবিতব্য। সে যে কেন দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারল না। কোনো কোনো দিন অত্যধিক মদ্যপান করলে সে এ—ভাবে একা বাথরুমে নীলরঙের আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরটা তার খালি মনে হয়। সেই বড় গম্বুজের মতো মুখের মানুষটাকে দু’নখে চিরে ফেলতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু সে জানে তার কাছে অথবা তাদের মতো মানুষের কাছে সে বান্দা। সে যা চাইবে তাই দিতে হবে। যদি সে তার সোমাকে চায়, এমন বৈভবের চাবিকাঠি তাদের হাতে সে না দিয়ে যাবে কী করে। কারণ না দিলেই সোমা আর দশভুজা থাকবে না। সোমা লক্ষ্মীছাড়া হয়ে যাবে।
বস্তুত একা দাঁড়িয়ে মনীষ যে কী ভেবেছিল নিজেও জানে না। সে বুঝতে পারছে শুধু এলোমেলো চিন্তা ওকে গ্রাস করছে। সে অসহায়ের মতো আয়নায় অবিরাম নিজেকে দেখে চলেছে। বস্তুত সে এতদিনে নিজের এই চেহারা চিনতে পারছে কিনা, এই মানুষই মনীষ দত্ত কিনা, ভেবে পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সে নিজেকে কেন জানি চিনতে পারে না। মাথার ভিতর তার কেমন গোলমাল হয়ে যায়।
এমন সময় ওর মনে হল পাশের বাথরুমে ফোয়ারা থেকে জল পড়ছে। জল পড়ার শব্দে ওর হুঁশ ফিরে এল। আয়না থেকে সে চোখ নামাল। ওপরের দিকে অহেতুক তাকাল সে। এ—সময়ে সোমা স্নান করছে। সোমা এই শীতের রাত্রিতে স্নান করছে। কিছু অপবিত্রতা তাকে সময়ে সময়ে গ্রাস করে, কী যে সেই অপবিত্রতা সে বুঝতে পারে না! গভীর রাতে কখনো কখনো বিছানা ছেড়ে সোমা বাথরুমে ঢুকে অনবরত ফোয়ারার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। আজও ওর এমন হয়েছে। মাঝে মাঝে সে এটা সোমার অসুখ ভাবত। চার বছরের ওপর ওরা এই বাড়িতে উঠে এসেছে। বিয়ের পরই সে এখানে উঠে এসেছে। সে কী জেনে ফেলেছে মনীষ দত্ত এই পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে বান্দা হয়ে আছে? প্রয়োজন হলে মনীষ দত্ত সোমা নামক এক সুন্দরী মেয়েকে অবহেলায় বিক্রি করে দিতে পারে? সে যে কী ভাবছে!