কাল অসিতকে একটা তবে কল দিচ্ছি।
তুমি যে কী না মনীষ! টাকার গাছ আছে তোমার।
শরীর ভালো লাগছে না বলছ। বুক কেমন করছে—
ঠিক হয়ে যাবে।
আবার চুপচাপ। ওরা হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢুকে গেল। বড় সব এমপ্লিফায়ারে গানের সুর ভেসে আসছে। মনীষ বলল, কতদিন আর বড় জলসাতে রাত কাটাই না। চল একদিন আমরা সারারাত গান শুনব।
এই শীতের সময় বড় সামিয়ানার নিচে বসে আলি হোসেনের সানাই অথবা গোলেমালির গান কী মজা! পাশে সোমার মতো মেয়ে বসে থাকবে, চুলে সুন্দর গন্ধ, তসরের বেনারসি পরনে, নীল রঙের ব্লাউজ, আর কপালে বড় সিঁদুরের টিপ চুল টেনে বাঁধা, পায়ে সে কখনও যদি রুপোর চেলি পরে যায় মনীষের মনে হয় রাত নিশীথে সে আর সোমা গানের জলসায় দুই বেহুলা—লক্ষীন্দর। সোমার সুন্দর চোখ দেখলে সে কিছুতেই আর রাগ পুষে রাখতে পারে না।
সোমা বলল, চল এখানেই আজ আমরা বসে যাই।
গেলে ভালো হত, আমরা আবার আমাদের পুরনো দিনগুলো ফিরে পেতাম। বস্তুত এই এক মানুষের রহস্য, কিছুদিন কাছে থাকলে ভিতরের রহস্য মরে যায়। মনীষ বিয়ের আগে সোমাকে দেখবে বলে গাড়ি চালিয়ে সেই দেবদারু গাছটার নিচে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত। কী মজা ছিল, কী যে মধুর মনে হত, এখন সে সব তার মনে হয় মরে গেছে। এত কাছে থাকলে শুধু বুঝি শরীরটা থাকে।
সোমা ইচ্ছা করেই নানা কথার ভিতর নিজেকে অন্যমনস্ক হতে দিচ্ছে না। সে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেই ধরা পড়ে যাবে বুঝি। সে কে? তাকে সে কোথায় দেখেছে? তার চোখ দেখে মনে হয়েছিল সে কিছু সোমাকে বলতে চায়। তার চারপাশে যে জীবন—প্রবাহ চলেছে, তার থেকে মানুষটা যেন আলাদা।
তার চোখে কী এক ভাষা ছিল, কী এক মাধুর্য ছিল যে কেবল তার অজান্তেই তাকে নদীর পারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
সোমা বলল, আমার কিছু ভালো লাগছে না মনীষ। তুমি কেন যে আমাকে কফি হাউসে নিয়ে গেলে?
কী ঘটেছে?
কী ঘটবে?
তবে তুমি এমন বলছ? মনীষ ইচ্ছা করেই ওর সেই অপলক দেখা এবং মতিবিভ্রম হয়ে যাওয়া খানিক সময়ের জন্য, এড়িয়ে গেল! সোমা নিজে থেকে কিছু না বললে সে—ও কিছু বলছে না। সে যেন ব্যাপারটা জানে না এমন চোখে—মুখে থাকল।
ওরা যেতে যেতে ফুটপাথে অজস্র ভিখারি দেখল। শীতের রাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে সব রাস্তায় সারি সারি শুয়ে আছে। কিছু গাছগাছালি আছে এখানে, কিছু অন্ধকার আছে, ভিতরে মনে হল কোনো পুরুষ রমণী পরস্পর আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আর দূরে একটা বাচ্চা ছেলে লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
মনীষ গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ননসেন্স! কলকাতায় ভদ্রভাবে মানুষের চলা দায় সোমা।
সোমা বলল, সবাই শরীর বেচে খাচ্ছে। ওদের আর দোষ কী।
তোমার আজ কী হয়েছে সোমা?
কী আবার হবে।
মনীষের কেমন আর্ত গলা শোনা গেল। গাড়িটা আবার গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। গ্যারেজের তালা খুলে সে ভিতরে গাড়ি রেখে দিল। মাথার ওপর আলো। এবং নানারকমের পোকা সেই আলোর চারপাশে। এমন সুন্দর আলো আর তার চারপাশে কত সব কুৎসিত নীলবর্ণের পোকা। মনে হল দু—একটা পোকা ওর মাথার ওপর এসে বসেছে। সে হাত দিয়ে সেই সব পোকা ধরতে গেলে দেখল ওরা উড়ে গেছে। হাতে সব পোকা ধরা যায় না, ধরে মারাও যায় না।
গাড়িটা ঢুকিয়ে গেট টেনে দিল এবং বড় একটা তালা ঝুলিয়ে দিল গেটে, গেটের ওপর পেতলের তালা, সেটা লোহার রডের সঙ্গে লেগে কেমন ঢঙ ঢঙ করে শব্দ করছে। সেই শব্দ মনীষের বুকে কী একটা তোলপাড় তুলে ওকে উধাও করে দিতে চাইল। সেই মানুষটা কে? সোমার কে হয়? সোমার আগে কোনো প্রণয় ছিল বলে তার জানা নেই। যদি থাকে সে কী তার ভিতর কেউ? নতুবা সোমার চোখে ওর চোখে এমন দুষ্টবুদ্ধি ধরা পড়ে গেছে কেন? ভিতরে ভিতরে মনীষ গুমরে মরছিল। তার কিছু জেদ আছে। সে সেই জেদের বশেই সোমাকে কিছু প্রশ্ন করল না। সোমাকে সে আপ্রাণ বিশ্বাস করে। মানুষের কিছু দোষ—ত্রুটি থাকে, সে সেটা নিয়ে না জন্মালেও ইনস্টিংক্ট তাকে সে সব বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্মাতে সাহায্য করে। এবং সোমারও যে এমন কিছু ঘটনা ঘটবে তাতে বিচিত্র কী। তবু এ সব ব্যাপারে সে যতটা জানে সোমা জীবনে কোনো কুৎসিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েনি। ওর মতো মেয়ের পক্ষে জড়িয়ে পড়া সম্ভবও নয়। এক সময় সে এই কফি হাউসের অনেককে চিনত। তার কবিতা লেখারও স্বভাব ছিল। সে প্রথমত এই এখানে কবিতার টানেই চলে আসত। কতদিন সে সোমাকে তার কবিতা শোনাবে বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে আর কাপের পর কাপ কফি নিজে খেয়েছে, বন্ধুবান্ধবদের জন্য অর্ডার দিয়ে গেছে। সোমা এলেই ওর প্রাণে জল আসত। সোমার বিধবা মা আর সে। বাবা কিছু টাকা ব্যাঙ্কে রেখে গেছেন সে এমন জানত। ওর মা খুব বুদ্ধিমতী এবং হিসেবি। সোমাকে এতটা বড় করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় সে যে হাজির করেছিল তার কৃতিত্ব যত না তার, তার চেয়ে বেশি মায়ের। সোমা বাড়ি থেকে গোনাগুনতি পয়সা নিয়ে বের হত। ওর কোনো কোনো দিন টিফিনের পয়সা থাকত না। সে এলেই প্রথম বলত, কী খাবে সোমা? কী অর্ডার দেব?
সোমার খেতে কোনো আপত্তি থাকত না। যা সে পছন্দ করত তাই সে অর্ডার দিত। তারপর কবিতা পড়া। সোমা ভালো না বললে সে কবিতা যথার্থই কিছু হয়নি তার এমন মনে হত। সে সেই কবিতা যে কতবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখেছে। ওর কিছু কবিতা লিটল ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়েছিল একসময়। সবই যেন প্রেমের ব্যাপারে পাল্লা দেওয়া। সে ছাত্র হিসাবে মোটামুটি ভালো। দেখতে রূপবান না হলেও মানানসই। সে তেমন উঁচু লম্বা নয়। তবু সোমার পাশে দাঁড়ালে তাকে বেমানান লাগে না। সে সোমাকে পাবে বলে যা সে করে না তাও করেছে।