মনীষ তখন কী বলেছিল? অজিতেশ প্রশ্ন করল।
মনীষ আর্তনাদ করে উঠেছিল। বলেছিল, কী বলছ সোমা!
বিনু বলল, ওভাবেই তুমি ওকে আরও বেশি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
অজিতেশ বলল, সোমার সেই যে শৈশবে স্বপ্ন ছিল, সুখী রাজপুত্রেরা এসে ওর বাবার মৃত্যুর শোধ নেবে, এবং সে কোনোদিন যেজন্য কাজল পরল না, অথচ বড় হতে হতে সে সুখী রাজপুত্র ভেবে মনীষকেই বিয়ে করে ফেলল, তারপর দেখা গেল, না মনীষ ঠিক সুখী রাজপুত্র নয়। বরং সে শহরের সেই সেরিফ ভদ্রলোকটির মতো, যার কাণ্ডজ্ঞান একেবারেই নেই—আর আমরা এ—ভাবে সবাই তরুণ বয়সে এমন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, বয়স বাড়ে, ক্রমে আমরা কঠিন রাস্তায় হেঁটে হেঁটে স্বপ্নের কথা ভুলে যাই। মনীষও ভুলে গিয়েছিল। সোমার তখন মনে হত, কেউ আসবে। আর এ—পথেই সোমার সংসারে গণ্ডগোল এমনভাবে দানা বেঁধে গেল যা মনীষের মৃত্যুর কারণ।
অসিত বলল, মনীষবাবু তো পালাচ্ছিল। অথচ ট্রেনের নিচে পড়ে গেল পালাতে গিয়ে।
আমরা এর আগে বিনুকে কিছু জিজ্ঞাসা করব। আচ্ছা বিনু, তুমি কি কোনো ভয় দেখিয়েছিলে!
সে বলল, না তো।
মনে করে দ্যাখো।
বিনু বলল, যেদিন সে পালিয়েছিল, সেদিন বিকেলের দিকে ওকে একবার ফোন করেছিলাম।
ফোনে কী বলেছিলে?
ফোনে…ফোনে! সে মনে করার চেষ্টা করল।—অঃ। মনে পড়ে গেল কথাটা। বলেছিলাম, কে এক জহুরিমল না হুজুরীমলের গলা কেটে দিয়েছে। ঘটনাটা চিৎপুরে ঘটেছিল।
একটা লোক ভয়ে মরে যাচ্ছে, তুমি ওকে আরও ভয় পাইয়ে দিলে। ওতো পালাবেই।
আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
কেউ আমরা বুঝতে পারিনি। অসিত বলল।
অজিতেশ বলল, আপনারা এখন বুঝতে পারছেন, ভয় কখনও কী ভয়ংকর হয়ে যায়। এবং অহেতুক মৃত্যুকে টেনে আনে! আমরা মনীষের কাছে কিছু শুনতে চাই। আসুন না আমরা ভাবি ঐ যে খালি চেয়ারটা রাখা হয়েছে সেখানে মনীষ বসে আছে। আপনারা সবাই ভাবুন খালি চেয়ারটাতে মনীষ বসে রয়েছে। ওকে সবাই আপনারা প্রশ্ন করুন। তারপর কী! তুমি কোথায় কীভাবে পড়ে গেলে, না কেউ তোমাকে কামরায় মেরে ট্রেনের চাকার নিচে ফেলে গিয়েছে। আপনারা সবাই কায়মনোবাক্যে প্রশ্ন করে যান। যান। বলুন। নিবিষ্ট হোন। দেখুন নীল অন্ধকারে খালি চেয়ার এবং সোমার সাদা সিল্কে একটাও চুমকি আর নেই, সব জোনাকি হয়ে গেছে। ছাদটাকে ছাদ আর মনে করবেন না, নীল আকাশ ভেবে ফেলুন। দেখুন সেখানে সব জোনাকি পোকারা একে একে সব নক্ষত্র হয়ে গেছে। আপনারা সবাই কোনো মহাকাশযানে চড়ে আত্মার অন্য স্তরে চলে যাচ্ছেন। ভাবুন, এ—ভাবে ভাবুন! দেখুন ঐ তো, ঐ তো মনীষ ঘাড় নিচু করে বসে আছে। চেয়ারটা আর খালি নেই। অন্ধকারের ভিতর থেকে চেয়ারটায় অস্পষ্ট কিছু যে দেখছেন, ঐ মনীষ। সে এবার আপনাদের মানুষের অধম চরিত্রহীনতার কথা বলবে। মানুষ যে কখনও সম্পূর্ণ নয় তার কথা বলবে। তাকে এবার চুপচাপ বলতে দিন।